ফিলিস্তিনের গণহত্যায় বাইডেনের লজ্জাহীন সমর্থন

গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামাসের আক্রমণের পর থেকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের নামে যা করছে তা এককথায় গণহত্যা। আন্তর্জাতিক আদালত, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইসরায়েলকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের কোনো কমতি নেই। গত মাসে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডা সিলভা ফিলিস্তিনে সংঘটিত গণহত্যাকে ইহুদিদের ওপর পরিচালিত হিটলারীয় হলোকস্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনের মানুষের সঙ্গে যা করা হচ্ছে তা ইতিহাসে কখনো হয়নি। তবে এটা ঘটেছে একবার : হিটলার যখন ইহুদি হত্যা শুরু করে।’ (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, আল জাজিরা)

সারা বিশ্বের মানুষের চোখের সামনে প্রতিদিন চলমান এই জায়নবাদী গণহত্যার অভিযান থেকে স্পষ্ট যে বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামো এখন কতটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে যখন কিনা পশ্চিমা প্রধান রাজনৈতিক চর্চা মানবতা হারিয়ে ফেলার পথে। পশ্চিমা বড় বড় শহরে এ গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে ও হচ্ছে যাতে অংশগ্রহণ করছেন বিশ্বের অনেক মানবতাবাদী ইহুদিও। তা সত্ত্বেও সেখানকার রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীনরা ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে চলেছে। 

পশ্চিমা বিশ্বে ঘটে যাওয়া এই নৈতিক অবক্ষয় সেখানকার ব্যাপক মানুষকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে তুলেছে আর প্রতিকারের কোনো উপায় না দেখে তা তাদেরকে হতাশাগ্রস্ত করছে। এরই এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আরোন বুশনেলের আগুনে আত্মাহুতি। বুশনেল যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য। 

তার বন্ধু লেভি পিয়ারপন্ট একই বিবেক দংশনের কারণে ২০২৩-এ বিমান বাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বুশনেলের প্রতিবাদী আত্মহত্যা নিয়ে গার্ডিয়ানে লিখেছেন, ‘আমরা এখন যা করতে পারি তা হচ্ছে তার সেই বার্তাটি শোনা যার ওপর তিনি আলো ফেলেছেন : গাজায় গণহত্যার নির্মমতা এবং এই সন্ত্রাসী কর্মকা-ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সরকারকে আয়কর প্রদানকারী ও সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে এই অপরাধে আমাদের সংশ্লিষ্টতা।’ 

অথচ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আজকের পশ্চিমা গণমাধ্যম বুশনেলকে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টায় লিপ্ত। তাদের পক্ষে এটা বোঝাই অসম্ভব যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের পক্ষে নিজের জীবন হরণ করে কোনো চলমান অনৈতিক ঘটনার প্রতিবাদ সম্ভব। 

ফিলিস্তিনে গণহত্যায় নিয়োজিত এই জায়নবাদী চক্র সম্প্রতি গঝঘইঈ-এর  মেহেদি হাসান শো থেকে নির্ভীক সাংবাদিক মেহেদি হাসানকে সরিয়ে দিয়েছে। তার ওপর তাদের আক্রোশের খড়্গ নেমে আসার কারণ তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা মিথ্যাবাদী মার্ক রেগেভকে সাক্ষাৎকারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার সকল মিথ্যাচারকে একে একে সামনে এনছেন। এরপরই তার ওপর জায়নবাদী চক্রের চূড়ান্ত আঘাত নেমে আসে ও তাকে গঝঘইঈ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সুখবর হচ্ছে মেধাবী সাংবাদিক মেহেদি তার নিজের নতুন স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে চালু করেছেন তবঃবড়।   

কিছুদিন আগে আবার গাজায় ঘটে গেল গণহত্যা। ক্ষুধার্ত মানুষেরা ত্রাণ হিসেবে আটা নেওয়ার জন্য ট্রাকের সামনে দাঁড়ালে তাদের মাথা ও বুক ঝাঁঝরা হলো ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলির বৃষ্টিতে। এই বর্বর আক্রমণে মুহূর্তে মৃত্যু হলো একশর বেশি মানুষের ও আহত হলো এক হাজারের বেশি মানুষ।  

জ্যাকোবিন সাময়িকীতে প্রকাশিত এক লেখায় ঝবৎধল অংংর বলেছেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড যুদ্ধাপরাধের উপরে যুদ্ধাপরাধ, যেখানে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে মানুষকে মাসের পর মাস না খাইয়ে রেখে তারপর হত্যা করছে, যাদের একমাত্র অপরাধ হচ্ছে ক্ষুধার্ত পরিবারের সদস্যদের জন্য আটা সংগ্রহ করতে লাইনে দাঁড়ানো। ফিলিস্তিনের সরকারি কর্মকর্তারা এই হত্যাকে বলেছেন, ‘ঠান্ডা মাথার খুন।’ 

এসব রক্তাক্ত ঘটনার কোনো কিছুই ইসরায়েলকে দমাতে পারেনি। গাজাকে জনশূন্য করে সেখানে ইহুদি রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে একচুল নড়েনি নেতানিয়াহু। আর এই মানবতাবিরোধী পরিকল্পনা সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। ফিলিস্তিনে প্রতিদিন যে বোমাগুলো পড়ছে সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কারখানায় তৈরি। ইসরায়েলে অস্ত্র তৈরির টাকাও আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেই অস্ত্র আবার বিক্রিও হচ্ছে আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাছে। এর (কু)নীতি হলো- সমগ্র ফিলিস্তিন দখল ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইসরায়েলকে প্রয়োজনীয় সবকিছু দেওয়া, অন্যদিকে আকাশ থেকে ফেলা খাদ্য সাহায্য নিতে আসা ক্ষুধার্ত মানুষদের গুলি করে মেরে ফেলতে ইসরায়েলি সৈন্যদেরকে সদা প্রস্তুত রাখা।  

ঝঃবঢ়যবহ ঝবসষবৎ জ্যাকোবিনে প্রকাশ করেছেন, ‘এ হামলার শুরু থেকে জো বাইডেন এ পর্যন্ত একশর বেশি যুদ্ধাস্ত্র-সজ্জিত জাহাজ পাঠিয়েছেন ইসরায়েলে।’ তিনি লিখেছেন, ‘৭ অক্টোবর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাইডেন ২১ হাজার বোমা সরবরাহ করেছেন, যার অর্ধেক ইসরায়েল ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনের মানুষের মাথায় ফেলেছে।’ 

বাইডেন যে মিষ্টি ভাষায় ইসরায়েলের সমালোচনা করছেন তা নেতানিয়াহুকে আরও উৎসাহিত করতে ভূমিকা রাখছে। বাইডেনের এক হাতে ইসরায়েলকে বোমা সরবরাহ ও অন্য হাতে ফিলিস্তিনে খাদ্য সাহায্য পাঠানো এক ঐতিহাসিক দ্বিচারিতা; যা এ গণহত্যাকে চলমান রাখতে সাহায্য করছে। এ গণহত্যা বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের এখনই ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। সম্মান করা উচিত আরোন বুশনেলের শেষ কথাকে : ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো।’   

লেখক:  সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //