আমাদের স্বাধীনতা

একদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য ডুবত না। এ কারণে ব্রিটিশের জাতীয় পতাকা তাদের রাজপ্রাসাদের অঙ্গনে দিন-রাত্রি উড়ত পত পত করে। এ কথা কিংবদন্তির মতো শোনালেও এই হলো ইতিহাস। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রান্ত জুড়ে ব্রিটিশরাই ছিল সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে বিশ্বে সবার শীর্ষে। এই অপরিমেয় শক্তি তাদের শেষ হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর। এর পর পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি দেশ ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে। দুইশ বছরের পরাধীনতার পর এ দেশের মানুষ তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা লালনের একটি ভূখণ্ড পেল। তারা নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়। কারণ বাংলায় ব্রিটিশ শাসন আসার পর কলকাতা রাজধানী হয়। পূর্ববঙ্গ থেকে সম্পদ ব্রিটিশ ছাড়াও কলকাতায় জমিদার ও বিত্তশালীদের ভোগের জন্য চলে যেত।

১৯৩১ সালে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। জনগণই পাকিস্তান এনেছিল ভোট দিয়ে। আবার সেই তারাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পরিষ্কার রায় দিয়েছিল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছর যেতে না যেতেই পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসন আর অবহেলা সেই স্বপ্নে আগুন ধরিয়ে দেয়। শুরু হয় বিভেদ, বিভেদ থেকে ঘৃণা। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ আমাদের দেশের মানুষের বিশ্বাস ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা তাদের মুক্তি দেবে। কিন্তু সেই কাক্সিক্ষত মুক্তি পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর পূর্ণ না হতেই শুরু হয় আন্দোলন মাতৃভাষার দাবিতে। রাজপথ কেঁপে ওঠে; সংগ্রাম চলতেই থাকে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আর তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে জনতার প্রাণের আকুতি, ভাষার দাবি নিয়ে। রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয় পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বাঙলির মাতৃভাষাকে। বাঙালির প্রথম জয়। সেখান থেকেই অংকুরিত হতে থাকে স্বাধীনতার বোধটি। এই অর্জন থেকেই নতুন স্বপ্নের বিজ রোপিত।

আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে ৬ দফার ভিত্তিতে এগিয়ে চলল আন্দোলন। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে, রক্ত পিছল পথে ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের সেই বিখ্যাত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গন্ধুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো জয় বাংলা। সে কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ল দেশের প্রান্তে প্রান্তে। সকলের পণ হয়ে দাঁড়ায় মুক্তি এবং স্বাধীনতা। পুরো বাংলাদেশটাই রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাস বলে যোদ্ধাদের শতকরা ৮০ জনই ছিল কৃষক। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল এই যুদ্ধ। বিশ্বখ্যাত একটি প্রশিক্ষিত চৌকস সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মুখের কথা ছিল না। সীমিত অস্ত্র নিয়ে এই জনতাই তাদেরকে মোকাবিলা করেছে গেরিলা যুদ্ধ, সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে। 

পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এদেশের আপামর জনতা। কেবল দেশে নয় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছে বিদেশেও। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেলাম স্বাধীনতা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আদি সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।’

মুক্তির জন্য লড়াই আমাদের দেশের মানুষের দীর্ঘকালের। ১৯৭১ সালে হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। সেই মুক্তির জন্যই লড়াই চলেছে। এখনো সংগ্রাম চলছে। আর ১৯৭১ সালে সেই স্বাধীনতার জন্যই জীবন দিয়েছে এ দেশের মানুষ। পাকিস্তানের অধীনতা থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। জনগণের কণ্ঠস্বর হয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। তাই তো এই যুদ্ধ জনতার যুদ্ধ, যা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত জনতার সংগ্রাম। এ দেশ জনতার। জনতাই বাঁচিয়ে রাখবে বাংলাদেশকে। জয় বাংলা। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //