বাংলাদেশ আবার বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে

বাংলাদেশ খুব বিচিত্র এক দেশ। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্তরা অপেক্ষা করে বসে থাকে কখন একটা দুর্ঘটনা ঘটবে আর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। অথচ তার ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে নিয়মকে অনিয়ম করার প্রতিযেগিতায় নিবেদিত থাকবে। সম্প্রতি বেইলি রোডের একটি ভবন পুড়ে ৪৬ জনের অকাল মৃত্যুর দায়ও একইভাবে কে কার ওপর ঠেলে দেবে তার চলমান প্রতিযোগিতা সাধারণ মানুষ দেখছে। ভবন মালিকসহ কয়েকজন ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। প্রকৌশলী, স্থপতি, রাজউক, সিটি করপোরেশন, মন্ত্রণালয় ইত্যাদি সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় রত। দেশ ও জাতির সামনে সবাই কীভাবে, কখন, কী ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার তালিকা পেশ করছে। কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন হলো সময়ের উদ্যোগ সময়ে নেওয়া হলো না কেন! হাত-পা বাঁধা সাধারণ মানুষ কিন্তু জানে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনৈতিক ব্যবসার ক্ষেত্র লুকিয়ে আছে। 

দেশে চাকরির বাজার সীমাবদ্ধ হওয়ায় জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য মানুষ বিভিন্ন ব্যবসায় নিয়োজিত হচ্ছে। এজন্য সরকারের কিছু নিয়ম-নীতি এবং তা দেখভাল করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তর আছে। ফলত ব্যক্তি যখন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমতি নিয়েই তা বাস্তবায়ন করে। তারপর থেকে যে অনুমতি দিল তার আর কোনো দায় নেই সব দায় যে অনুমতি নিল, বাস্তবায়ন করল তার বা তাদের। বেইলি রোডের ভবনটি যদি রেস্তোরাঁ করার উপযোগী না-ই হয় তবে অনুমতি দেওয়া হলো কেন? তাও একটা নয় বেশ কয়েকটা রেস্তোরাঁ করার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হলো। ফলে এখন ভবনের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে লাভ কী? শুধু অকালে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য শোক প্রকাশ করে দায় এড়নো কতটা যৌক্তিক ভেবে দেখা দরকার। আর ভাবা দরকার অর্থ দিয়ে সব মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হয় কিনা? যদিও আমরা সবাই জানি অন্য আর একটা ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিজেদের দায়িত্ব কে কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে বা করছে তার প্রমাণ দিয়ে চলবে এবং তারপর যথারীতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। 

সারা দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সরকারি হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখানেও কিন্তু সরকারি একটা নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালাকে পাশ কাটিয়ে করা হাসপাতালগুলো পরিচালনার অনুমোদন কে দিয়েছে কেউ প্রশ্ন তোলে না, ভাবা তো অনেক দূরের কথা। অথচ অপচিকিৎসায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটামাত্র শুরু হয়ে যায় সালতামামি প্রকাশ। কার কার অনুমতি নেই, চিকিৎসকের পরিবর্তে অচিকিৎসক সেবা দিচ্ছে কোথায় কোথায়, প্রয়োজনীয় লোকবল নেই, পরিবেশ নেই ইত্যাদি। প্রয়োজনে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিযোগিতাও চলে কয়েক দিন। তারপর আবার পুনর্মূষিকোভব। কিছু দিনের মধ্যে আবার সদর্পে চালু হয়ে যাবে প্রতিষ্ঠানটি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা তত দিনে ম্যানেজ হয়ে যাবে। উচ্চমহলের কেউ প্রশ্ন করবে না কীভাবে এই হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোকে ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে? 

শুধু বেসরকারি হাসপাতালে নয়, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এমন অরাজক উদ্যোগ চলমান। ন্যূনতম শিক্ষার পরিবেশহীন, উপকরণহীন অবস্থার একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। আসলে দেশে মানহীন শিক্ষায় সনদ বিক্রির এ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার অনুমোদন যারা দিল তাদের বিচার আগে হওয়া প্রয়োজন। তা হলেই পরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করার প্রবণতা থেকে আমরা বের হতে পারব। যদিও অনেকেই মনে করেন সামগ্রিক বিষয়টি তর্ক সাপেক্ষ। 

দেশে যে কোনো নৈতিক বিষয়ে অনুমোদন পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। বিপরীতে অনৈতিক অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্টদের সন্তুষ্ট করতে পারলেই অনুমতিপত্র বাড়িতে পৌঁছে যায়। সাধারণ জনগণ একদিকে দেশের সর্বত্র জনবলের সংকট শুনতে শুনতে রোগা হয়ে গেল, আবার সেই জনগণই দেখে অনৈতিক অনুমোদন প্রদানে জনবল কিংবা সময় কোনোটারই কোনো ধরনের সংকট নেই। জবাবদিহিতাহীন, দায়বদ্ধতাহীন সমাজ ব্যবস্থায় বেইলি রোডের ভবনে অনুমোদনহীন কোনো ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে এমন দাবি কিন্তু কেউ করেনি। এখন শুধু চলছে দায় অস্বীকারের পালা। অথচ কেউ ভাবে না যে কোনো কিছু অনুমোদনের জন্য স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কযুক্ত, ফলে আজ অস্বীকার করার কোনো প্রচেষ্টাই সাধু হতে পারে না। তাজরিন গার্মেন্টস থেকে নিমতলী অগ্নিকা- হয়ে আজকে বেইলি রোড। সর্বত্র দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহিতার ধরন একই। 

দেশে আজ স্বাধীনতা মানে দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতি করার সুযোগ, সন্ত্রাসীকে সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়ার অধিকার, মজুদদারকে পণ্য মজুদের সুযোগ, আমলাদের ঘুষ নেওয়াকে প্রশ্রয় দেওয়া, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার করার অধিকার। স্বাধীনতা মানে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলা, নিজেদের যা ইচ্ছা তাই করা নয়এ কথা যেন সবাই বিস্মৃত হয়েছে। ভুলে গেছে, স্বাধীনতা মানে দেশকে শিল্পে, বাণিজ্যে, শিক্ষায়, কারখানায় উৎপাদনে আবিষ্কারে এগিয়ে নিয়ে চলা। আমরা যারা দেশের সাধারণ জনগণ, দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলার পরিণাম আমরা জানি। তাই কেবল সুবিধাপ্রাপ্তিই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। সে কারণে বেইলি রোডের ভবনে ব্যবসা পরিচালনাকারীরা কোনোভাবেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। সকল পক্ষেরই গুরুত্ব বিবেচনায় বিচার হওয়া আবশ্যক। 

- সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //