বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভোক্তার জ্বালানি সুবিচার

২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গিয়ে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে। তারা বলছে এই দাম বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু আমরা মনে করি যে, বিকল্প ছিল। আইনের চোখে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি প্রতিরোধ করলেই হতো। সরকার সেই পথে হাঁটেনি। যখন তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ভোক্তার ওপর জুলুমের শামিল।

দ্বিতীয়ত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় তারা ভোক্তাদের জিজ্ঞেস করেনি। বিইআরসি বা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইন তো বহাল আছে। গণশুনানির মাধ্যমে দাম বাড়ালে জনগণ সরকার কোন খাতে কী খরচ করেছে, কেন সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে- সে সম্পর্কে স্পষ্ট থাকত। এভাবে দাম বাড়ানোতে জনগণ সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারেই থেকে গেল।

বাংলাদেশে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে তিনটি আইন আছে- ভোক্তা অধিকার আইন, প্রতিযোগিতা আইন এবং বিইআরসি আইন, এগুলো সরকারেরই করা। তারাই আবার ভোক্তার জ্বালানি অধিকার খর্ব করে। ভোক্তার ওপর জবরদস্তিমূলক মূল্যহার বৃদ্ধির কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। অথচ আমরা সেটাই দেখছি।

সরকার এটি করতে পারে না। ভোক্তার সঙ্গে সরকারের যে চুক্তি, তা এখানে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর সরকার ভূতাপেক্ষ দাম বাড়াতে পারলে ভোক্তাদের কাছ থেকে অতীতে জ্বালানি তেলের যে বেশি দাম নেওয়া হয়েছে, সেটাও ফেরত দিতে হবে। জনগণের করের অর্থে পরিচালিত পেট্রোবাংলা বা বিপিসি তাদের আইনমতে মুনাফা করতে পারে না। অথচ তারা সেটা করেছে। 

সরকার জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে বাণিজ্যিক উন্নয়ন কৌশল নিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া সে উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। মূল্যহার নির্ধারণ করতে হবে ভোক্তার কথা শুনে। ভোক্তাকে মতামত দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আইন করে বা অন্য কোনোভাবে এসব রহিত করা যায় না। অথচ ভোক্তারা সেই অবস্থার শিকার।

এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে। বিদ্যুতের বিল কত বৃদ্ধি হলো সেটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই বৃদ্ধি প্রতিটি পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি করবে। তাতে ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। ভোগব্যয় কমিয়ে দেওয়ার কারণে পণ্যষেবা কেনাবেচা কমবে। ফলে ট্যাক্স, ভ্যাট, শুল্ক ইত্যাদি বাবদ সরকারের রাজস্ব আদায় কমবে। তাতে সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়বে। সে হিসাব বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে নেই।

আমরা নিকট অতীতের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখব যে, জ্বালানি খাতে ভয়াবহ লুণ্ঠনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০১০ সালে সরকার রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ করে দিল। বেসরকারি খাতে সুযোগ মানে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা। কিন্তু সেটি না করে সরকার গোষ্ঠীবিশেষকে প্রতিযোগিতাহীন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে। তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রথমে আইনটি করা হয়েছিল দুই বছরের জন্য। সর্বশেষ পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়ানো হলো। এখন শোনা যাচ্ছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত এটি চলবে। আইনটি নিয়ে আদালতে যাতে কোনো প্রশ্ন করা না যায়, সে জন্য দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। কাউকে দায়মুক্তি দেওয়ার অর্থ, এর পেছনে রহস্য আছে।

জনগণের যে জ্বালানি সুবিচার বা এনার্জি জাস্টিস পাওয়ার কথা, সেটা থেকে তারা বঞ্চিত। এটা চলতে পারে না। যেসব আইনের আওতায় ভোক্তার জ্বালানি অধিকার খর্ব করা হয়েছে, সরকার সেটা উপেক্ষা করতে পারে না। অথচ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০১০ দ্রুত বলবৎ এবং বিইআরসি আইন ২০০৩ পরিবর্তন করে ভোক্তার অধিকারের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। ভোক্তাকে অন্যায্যভাবে জ্বালানি সুবিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের একটা বিশাল ধস নামানো হয়েছে। আর এগুলো ধ্বংস হলে তো রাষ্ট্র ও সমাজ টিকে থাকতে পারে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বোধ হয় এখন উল্টোপথে যাত্রা করছে।

লেখক: জ্বালানী বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //