আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার

প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে, বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের অতীত ইতিহাসের দিকে একটুখানি দৃষ্টিনিবদ্ধ করলে আলোচনায় সুবিধা হবে। ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের তার ভ্রমণ কাহিনিতে ষোলো শতকের ভারতবর্ষে মোগল শাসনব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করে লিখেছেন- প্রাচ্য দেশে (ভারতবর্ষে) সাধারণ লোকেরা সুবিচারের জন্য আইনের সাহায্য নিতে পারে না কেন? কেন তারা উজির (প্রধানমন্ত্রী) ও সম্রাটের কাছে তাদের অভিযোগ, আবেদন-নিবেদন করতে পারে না? বিচারের কোনো বিধানই সেখানে নেই, এমন তো নয়। স্বীকার করি, ভারতবর্ষেও আইনকানুন, বিধি বিধান আছে। আরও স্বীকার করি, সুষ্ঠুভাবে সেসব বিধান প্রয়োগ করলে এবং মানুষকে সচেতন করে তুললে ভারতবর্ষসহ অন্যান্য এশীয় দেশ মানুষের জন্য স্বর্গতুল্য দেশ হতে পারত। 

কিন্তু ভালো ভালো বিধান থাকলেই তো হয় না। কার্যক্ষেত্রে যথাযথভাবে সেগুলো প্রয়োগ করতে হবে এবং জনগণকে আইনের সাহায্য নেওয়ার পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু আইনের যথার্থ প্রয়োগ যদি না হয় তাহলে হাজার বিধান থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বিচারের কোনো আশা নেই। ন্যায়বিচার না থাকলে সেই দেশ নরকতুল্য হতে বাধ্য। (বিনয় ঘোষ : বাদশাহী আমল)। 

ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বার্নিয়ের ভ্রমণ বৃত্তান্তে আরও বলেছেন- প্রাদেশিক সুবেদাররা অন্যায় করেন, অত্যাচার করেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেন পদে পদে। কিন্তু সাম্রাজ্যের সম্রাট কি প্রত্যেকবারই ওই একই চরিত্রের লোকদের ওইসব পদে নিয়োগ করেন না? কারণ, সম্রাট তার সাম্রাজ্যকে এইসব মন্দ লোকের কাছে একরকম বিক্রি করে দেন বলা চলে। যারা বেশি বেশি তোয়াজ করেন, উপঢৌকন দেন, ভেট পাঠান, তাদেরকেই তিনি শাসনকার্যে নিয়োগ করেন। (প্রাগুক্ত)। 

এখন কথা হলো। পাঁচশ বছর আগের ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বার্নিয়েরের উপরোক্ত বক্তব্য পাঠ করলে মনে হয় না কি, আজকের ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোর শাসনব্যবস্থা, শুধু ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ ও ‘আধুনিক শাসনব্যবস্থা’ তকমা ছাড়া, প্রায় হুবহু পাঁচশ বছর আগের মতোই? প্রশ্নবিদ্ধ এই কথাগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুবই অতিরঞ্জিত, এবং আপত্তিকর মনে হলেও বাস্তব পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। কারণ আজকের আধুনিক ‘সম্রাট’দের নানা নামের, পদের আধুনিক অধীনস্থরা দুর্নীতি, রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ আত্মসাৎ, রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদ লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দেশের বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার ইত্যাদি ‘মহৎ’ কর্মকা-ের মাধ্যমে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে বড়ই করিতকর্মা। 

আমাদের প্রতিবেশী দেশ আধুনিক দিল্লি শাসিত ভারতের একটি উদাহরণ দিই। প্রখ্যাত ভারতীয় পণ্ডিত ও অর্থনীতিবিদ অশোক মোদি তার ‘ইন্ডিয়া ইজ ব্রোকেন’ গ্রন্থে, সে দেশের আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে লিখেছেন, ‘একদিকে বস্তিবাসী ভারতীয়রা উচ্ছেদের আশঙ্কায় থাকেন, অন্য দিকে মুকেশ আম্বানির ২৭ তলা প্রাসাদ নির্মিত হয়। একদিকে নিঃস্ব কৃষকরা ঋণের চাপে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, অন্যদিকে বিজয় মালিয়ারা রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণখেলাপি হয়ে বিদেশে পাড়ি জমান।’ আমাদের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের অবস্থাও কি তদ্রƒপ নয়?

অর্থনীতিবিদ অশোকা তার বইয়ে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনীতি এবং প্রভূত ‘উন্নয়নের’ অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নের ব্যাখ্যায় বলেছেন- ‘সমাজ হচ্ছে রাজনীতি ও অর্থনীতির আয়না। যখন নৈতিক আদর্শ ভেঙে পড়ে, তখন সবাই ধরেই নেয়, অন্যরা প্রতারণা করবে; তখন সবাই প্রতারণা করে এগিয়ে যেতে চায়। এ ধরনের আমি-আমি-আমি ভারসাম্যে (ইকুলিব্রিয়ামে) নাগরিকদের পক্ষে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি, লুটপাট, নদী ভরাট, ঋণখেলাপি, মুদ্রাপাচার, ওষুধসহ নিম্নমানের পণ্য বিক্রি ইত্যাদি কার্যক্রমে লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে। এভাবে সমাজে একদিকে চরম বেকারত্ব ও সামাজিক সহিংসতা, অন্যদিকে অভিজাত শ্রেণির উন্নয়নের উপাখ্যান সমান্তরালভাবে চলতে থাকে।’ 

এ ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থাও একই রকম। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, বর্তমান বিশ্বের, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের সকল আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী দেশগুলোর চেহারা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সাধারণভাবে মোটামুটি একই রকমের। তারপরও এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের অনেক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন বাংলাদেশের অবস্থা চীন, মালয়েশিয়া, ব্যাংককের মতো নয়; মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মতোও নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলোরাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, ‘আইনের শাসন’. ‘ন্যায়বিচার’ প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গেই বাংলাদেশের সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি। বলতে গেলে ষোলো আনাই। 

আজকের শতকের খণ্ডিত ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোর শাসনব্যবস্থাকে আমরা মূল্যায়ন করি নানা প্রেক্ষাপটে। সেখানে থাকে শ্রেণি; জাতিগত, নৃতত্ত্বগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বর্ণ ও নারী- এরূপ নানা প্রশ্ন। থাকে একটি রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর জাতীয় মুক্তি এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। পনেরো-ষোলো শতকের (মধ্যযুগের) রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা আজকের মতো এতটা জটিল ছিল না। তাই ষোলো শতকের ভারতবর্ষকে মানুষের জন্য স্বর্গতুল্য করে তোলার জন্য ফ্রঁসোয়া বার্নিয়ের কোনো গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের কথা কল্পনাও করেননি। রাষ্ট্রপরিচালনায় তিনি চিন্তা করেছেন এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেছেন ‘আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠাকে। বার্নিয়ের একটি রাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতির মূল জায়গায় হাত দিয়েছিলেন। বর্তমান যুগেও আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলি বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলি, সকল প্রকারের রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার মূল জায়গা হলো আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার, যা না থাকলে কোনো রাষ্ট্রই টিকে থাকতে পারে না। পৃথিবীতে অনেক ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র বা ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে গেছে, শুধু আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হওয়ার জন্য। আমরা অদূরভবিষ্যতে যে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করি, এমনকি সুদূর ভবিষ্যতে যে পরিপূর্ণ সাম্যের সমাজের চিন্তা করি, সেটিও হবে মূলত সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ের সমাজ, অর্থাৎ ন্যায়বিচারের সমাজ।

বর্তমান অবস্থায় আপাতত যেটি করা সম্ভব সেটি হলো কোনো ‘চিরস্থায়ী’ বন্ধুরাষ্ট্র কিংবা সাধারণ কোনো বন্ধু বা শত্রুরাষ্ট্র হোক, যে কোনো বহির্শক্তির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক আধিপত্য, হস্তক্ষেপ ও ‘দাদাগিরির’ ভার থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সহনীয় একটি উদারনৈতিক আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তা হলেই রাষ্ট্রের সমস্ত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে স্বর্গতুল্য না হলেও, অন্তত অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে একটি আত্মনির্ভরশীল স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এর আর কোনো বিকল্প নেই।

-লেখক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //