বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কি ব্যর্থ

আমাদের এক মন্ত্রী সবাইকে খেজুরের বদলে বরই দিয়ে ইফতার করতে বললেন; কিন্তু শুধু কি খেজুরের দাম বেড়েছে বলুন? চালের বদলে এক সময়ে আটা খেতেন গ্রামের মানুষ। আটারও দাম বেড়েছে এখন। শুধু পানি খাবেন? এর দামও বেড়েছে। বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। গত তিন বছরে জিনিসপত্রের কয়েক দফা দাম বেড়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়েছে। ইফতারে খেজুরের বদলে বরই মন্ত্রী খাবেন কিনা আমি জানি না, তবে ভাত তো খেতে হবে কম-বেশি সকলের। চাল নিয়ে, পেঁয়াজ নিয়ে, চিনি নিয়ে চিনিমিনি রোজার আগেই কয়েক দফা হয়ে গেছে। ভরা মৌসুমেও সত্তর টাকার নিচে নেই বেশিরভাগ সবজির কেজি দর। এর আগে কখনো এমন ছিল? বাজার নিয়ন্ত্রণের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশে নেই। তাই অকারণেই হঠাৎ করে বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। আবার একবার কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সহজে কমে না। ফলে কারণ ছাড়াই কিংবা কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অধিক মুনাফা লাভের কৌশলে সাধারণ মানুষের জীবন দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।

আসলে বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখেছি, খেজুর আমদানিতে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। আমার মনে আছে, অনেক ব্যবসায়ী গত বছর রোজার আগে আজোয়া ও মেডজুলের মতো দামি খেজুর প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ১ মার্কিন ডলারে আমদানির ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল, বাজারে এসব খেজুর বিক্রি হয়েছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা কেজি দরে। মোদ্দা কথা, শুল্ক-কর ফাঁকি দিতেই আমদানি মূল্য কম দেখিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত বছর চট্টগ্রামে খেজুরের বাজারে জেলা প্রশাসনের অভিযানে আমদানি মূল্য অস্বাভাবিক কম দেখিয়ে শুল্ক-কর ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি সবার নজরে আসে। এরপর কাস্টমস কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তারা খেজুর আমদানিতে করভার বাড়িয়ে দেয়। আবার শুল্ক-কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম আমদানি মূল্যও বেঁধে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রতি কেজি খেজুর আমদানিতে এখন করভার সর্বোচ্চ ২৬৫ টাকা। এতে খেজুর আমদানি থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়লেও এই চাপ গিয়ে পড়ছে ভোক্তাদের ওপরই। কেননা করভারের চাপে বাজারে খেজুরের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। শেষমেশ মন্ত্রী মহোদয়ের পরামর্শ, বরই দিয়ে ইফতার করুন।   

জানা কথা, বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই রোজার আগে ভোগ্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হয়। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসময় দামও বেশ বেড়ে যায়। এবার এসবের বাইরে সবচেয়ে বড় চিন্তা সাধারণ মানুষের গ্যাস- বিদ্যুতের দাম নিয়ে। রোজার আগেই বিদ্যুতের দাম বাড়লো। এর সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এবছর রোজা শুরু হওয়ার বেশ আগেভাগেই বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। এখন গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আরেক দফা দাম রোজার আগে পরে বাড়বে এটা নিশ্চিত। 

গত জানুয়ারিতে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। তারা ক্ষমতা গ্রহণ করেই  দ্রব্যমূল্য যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণায় সাধারণ মানুষ আশান্বিত হয়েছিল। কিন্তু কথা অনুযায়ী কাজ হয়নি। দাম বেড়ে যাওয়া বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের মূল্য ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণপত্র (এলসি) খোলা নিয়ে নানান জটিলতার কারণে সার্বিকভাবে পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আর এ কারণে পণ্যের দাম স্বাভাবিক ভাবেই বেড়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও কিছু ‘অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ’ বাড়তি মুনাফা পেতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। 

গ্যাস- বিদ্যুতের দাম কেমন বেড়েছে, আসেন একটু দেখি। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি ওজনের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ছিল ৯৯৯ টাকা। মাত্র আট মাসের ব্যবধানে চলতি মার্চ মাসে সমপরিমাণ এলপিজির দাম বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৮২ টাকা। এর মানে হলো, সরকারিভাবেই বেড়েছে ৪৮৩ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দর বিবেচনায় বিইআরসি প্রতি মাসের শুরুতে এলপিজির দাম সমন্বয় করে দেয়। মার্চ মাসের জন্য ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম আগের মাসের চেয়ে ৮ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৮২ টাকা। এই দাম মার্চের ১ তারিখ থেকেই কার্যকর হয়েছে। আর বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি সর্বনিম্ন ৩৪ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৭০ পয়সা বাড়ার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী। এর মানে হলো, বিদ্যুতের দাম গড়ে ইউনিট প্রতি ৫২ পয়সা করে বাড়বে। বিদ্যুতের এই নতুন দাম ১ মার্চ মাস থেকে কার্যকর হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের যে দাম তাতে দেশের বাজারে দাম আরও কমার কথা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে তেলের দাম আরও বেশি হওয়ার কথা। এ বিষয়ে যেসব খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভর্তুকি তুলে দিতে চায় সরকার। এ কারণে পর্যায়ক্রমে আগামী তিন বছর ধরে মূল্য সমন্বয় করা হবে। তেল-গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়বে। তাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। 

যতদূর জানা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনও আছে; কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা হয়ে পড়ছেন নিয়ন্ত্রণহীন। এমন পরিস্থিতিতে ট্রেডিং করপোরেশন বা টিসিবির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। না হলে অচিরেই এসব অসাধু ব্যবসায়ীর হাতে মানুষ জিম্মি হয়ে পড়বে। বর্তমান অবস্থায় মনে হচ্ছে, সরকারসংশ্লিষ্ট মহলগুলো জিনিসপত্রের দাম পর্যবেক্ষণ করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে একটি সংস্থা রয়েছে; কিন্তু তাদের কার্যক্রমও তেমন লক্ষণীয় নয়।

আমাদের দেশে অতি মুনাফা লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই গড়ে তুলেন মজুদ। আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের, বিশেষত আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে না উঠলেও স্থানীয় বাজারে এ পরিবর্তনকে আগাম সতর্ক সংকেত হিসেবেই দেখতে হয়। কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠলে খুচরা ব্যবসায়ীদের পাইকারি ব্যবসায়ীরা দায়ী করেন। আবার খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী করেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের। অনেকে আবার আমদানিকারকদেরও অভিযুক্ত করেন। এভাবে নানা অজুহাতে দাম বাড়ার কাজ চলে। তাছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার কাজটি করতে হয়। এ কারণে অধিকাংশ সময় সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সেবা চালু করার চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।

বিশ্বজুড়ে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভারতবর্ষে মধ্যযুগে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী দ্বারা গৃহীত বাজার নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। এ ছাড়া প্রতিটি দেশের সরকারই নিজের দেশে দ্রব্যের দাম যাতে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে না চলে যায় তার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ তথা আইন প্রণয়ণ করে থাকে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এক্ষেত্রে কী ধরনের নীতি অবলম্বন করছে, তাও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য সাধারণে মানুষের নাগালের বাইরে গেলে তা সরকারের ওপর মানুষের অসন্তুষ্টি তৈরি করে এটা খুব জানা কথা। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সাধ্য অনুযায়ী সব উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে সীমিত আয়ের মানুষ দিশাহারা। এ অবস্থা যাতে দীর্ঘায়িত না হয়, সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্টরা একটু বিশেষ নজর দেবেন কি?

- কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //