আমার ভাষা আমার পরিচয়

ভাষা শুধু মনের ভাব প্রকাশের বা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম বা প্রশাসন পরিচালনার অন্যতম হাতিয়ারই নয়, একটা সত্তার প্রতীকও। একটা নির্দিষ্ট ভাষাকে অবলম্বন করে একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বিশ্বের কাছে তাদের জাতীয় অস্তিত্ব তুলে ধরে। 

ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে তখনকার বড় বড় নেতারা প্রায় সবাই ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেন। তারা মনে করতেন, বাংলায় বুঝি বক্তৃতা দেওয়া যায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এটা ভালো লাগত না। তিনি ভাবতেন, বক্তৃতায় আমাদের দেশি ভাষা কি ব্যবহার করা যায় না! 

সেই সময়কালে লালমোহন ঘোষ নামে একজন তুখোড় বক্তা ছিলেন। তাকে একদিন রবীন্দ্রনাথ বললেন, আপনারা এই যে ইংরেজিতে বক্তৃতা করেন, এসব দেশের সাধারণ মানুষ বোঝে? তখন লালমোহন বললেন, ‘ঠিক আছে, রাজশাহীতে আপনার ওখানে যখন বক্তৃতা করব, তখন আপনি বাংলায় অনুবাদ করে দেবেন।’ এবং রাজশাহীর সেই সভায় বড় বড় নেতারা যেসব বক্তৃতা দিলেন, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তা বাংলায় অনুবাদ করে বললেন। সভা শেষে লালমোহন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বললেন, ‘ওয়েল রবি বাবু, ডিড ইওর চাষা অ্যান্ড ভুষাজ আন্ডারস্টুড ইওর ফ্লাওয়ারি বেঙ্গলি?’

চাষাভুষারা রবীন্দ্রনাথের পরিশীলিত, প্রমিত বাংলা ঠিক ততটা বুঝতে পারেনি বলেই লালমোহন ঘোষের বিশ্বাস। 

ভাষা যেখানে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। সেই মাধ্যম হিসেবে যে ভাষা ব্যবহার করা হয় সেটা আসলে একটা বড় ভূখ-ের মানুষ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। তাই আন্দোলনের ভাষা, বিপ্লব সংগঠনের ভাষা অবশ্যই মাতৃভাষায় হওয়া সঙ্গত। রবীন্দ্রনাথ এটা ভেবেছিলেন সন্দেহ নেই । 

বিশ্বের কোথাও লিখিত ভাষা আর মুখের ভাষা এক নয়। তাই বলে ভিন্ন ভাষার আগ্রাসনকে বাধা না দেওয়া নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ত্রিশের দশকে আসাম ব্যবস্থাপক সভায় মওলানা ভাসানী বাংলায় বক্তৃতা করতেন। এবং ব্যবস্থাপক সভায় তার করা প্রশ্নের উত্তরও তিনি বাংলায় আশা করতেন। বাঙালি এবং অসমিয়া হওয়া সত্ত্বেও অন্য সব সদস্য তাদের বিদ্যাবুদ্ধি প্রমাণের জন্য ইংরেজিতে ভাষণ দিতে অভ্যস্ত ছিলেন। মওলানা ভাসানী সেখানে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য দাবি জানান। পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের আসাম বিধান সভায় বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পায়। এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির পথ তৈরি করার জন্য আসামের বাংলা ভাষাভাষীরা আজও মওলানা ভাসানীর কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রভাষা অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা- অফিস আদালতে, পরীক্ষায় সর্বত্র বাংলা ব্যবহারের দাবি জানানো হয়। 

একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে যখন বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বাস থাকে তখন ভাষা নিয়ে তাদের আবেগের, লড়াইয়ের বা সংগ্রামের জায়গাটা ঠিক কোন পর্যায়ে থাকে এটা বাংলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস না পড়লে বোঝা যাবে না। বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির লড়াই ছিল এক দশক বা তারও বেশি সময়কাল জুড়ে। বাংলা ভাষার ওপর আধিপত্যবাদ এসেছে বারবার। এই শোষণের প্রতিবাদে তীব্রতম প্রতিবাদের প্রকাশ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। রাজনৈতিক তাৎপর্য ছাড়াও বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়কে ঘিরে যে অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতার কুয়াশা তাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, এই আন্দোলনই প্রকৃতপক্ষে সেই কুয়াশাকে সরিয়ে বাঙালি সত্তার উন্মেষ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার বহু রক্তাক্ত স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও এ-কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, এই নিরন্তর আন্দোলনের পরিণতিতেই ‘বাংলাদেশ’ নাম-পরিচয়ে মাতৃভাষাভিত্তিক একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম সম্ভব হয়েছে। তবে বিশ্বায়নের কারণে আধুনিক মানুষ তার মাতৃভাষার বাইরে আরও ভাষা শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। বিশ্বায়ন মানে যেখানে রাষ্ট্রগুলোর সীমারেখা আর খুব বড় কথা নয়। ফলে প্রাথমিক থেকে সর্বস্তরের শিক্ষায় ‘বিশ্বভাষা’ হিসেবে ইংরেজির ভূমিকা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যার ফলে অনেকের ভেতরে এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে যে ভাষাটা বেশি শক্তিশালী সেটাকে আমরা বেশি প্রাধান্য দেব। নিজের ভাষাটা কম শক্তিশালী তাই একে ততটা গুরুত্ব না দিলেও চলবে! 

এ ক্ষেত্রে আমাদের উদ্বেগের কারণ এখানে যে, আমাদের ভাষাটা বিপন্ন হয়ে উঠছে না তো! আমাদের ভাষায় অসাধারণ সাহিত্য আছে, গান আছে, চলচ্চিত্র আছে। এখন অন্য একটা ভাষার আগ্রাসন আমাদের ভাষাটাকে গৌণ করে দেবে না তো? এ বিষয়ে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ডেথ’ নামে একটা বই লিখেছেন ডেভিড ক্রিস্ট্যাল। তিনি এই প্রশ্নটা সেখানে তুলেছেন। তিনি একটা মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে বলছেন যে, ‘নিজের ভাষাটাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আরও শক্তিশালী করব। আবার একটা বৃহৎ যোগাযোগের ভাষাকেও আমি গ্রহণ করব।’ 

ভাষা মানব সভ্যতার এক অমূল্য সম্পদ। নিজ নিজ ভাষা নিজ নিজ জাতি গোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে। তাই মানুষ সবকিছু মেনে নিতে পারলেও ভাষার বিলুপ্তি মেনে নিতে পারে না। ভাষার বিলুপ্তি একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সভ্যতারও বিলুপ্তি। তাই বিশ্বায়নের যুগে বহু ভাষার আগ্রাসন হয়তো ঠেকাতে পারব না, তবে নিজের ভাষা টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও আমার।

-কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //