সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়া স্বাগত দর্শক

কাগুজে পত্রিকা মরিয়া গিয়া বাঁচিয়া উঠিয়াছে। তবে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায়। তাহলে কোনটা আসল পরিচয়, কাগজ না ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট? কাগুজে পত্রিকা আজকাল খুব বেশি কেউ পড়ে না, এমনকি টেলিভিশন সেটের সামনে বসে দেখা মানুষের সংখ্যা কমছে দ্রুত। সব কিছু দেখে ডিভাইস মানে স্মার্ট ফোনে। আর পত্রিকা শুধু ই-পেপার বার করে না, আলাদা চ্যানেল খোলে পত্রিকার খবর পাবলিকের কাছে নিজের প্রচার করতে। সোজা কথা পাঠক এখন দর্শক। আর দর্শক সবই চায়। 

দুই
বহু পত্রিকা আছে যাদের পাঠকের চেয়ে দর্শক বেশি। অনলাইন সবার বড় ভাই এখন। মজাটা হলো, দেশ থেকে প্রচারিত অনেক অনলাইন পত্রিকার চেয়ে বিদেশ থেকে প্রচারিত সোশ্যাল মিডিয়ার আলাপ অনেক ক্ষেত্রে বেশি জনপ্রিয়। পুরান হিসাব আর নাই। গণ মাধ্যম, তুমি কী, কে এবং কার?

তিন
সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু একক কোনো সত্তা নয়, এর একাধিক সত্তা আছে, যার ভেতর আছে আরও অনেক স্তর। মানুষ এটাকে প্রথমে আনন্দ, লাইফস্টাইল, বিশেষ করে স্ক্যান্ডাল যা অন্য পরিসরে অত উগ্রভাবে দেখা যায় না, পাবার পরিসর হিসেবেই নিয়েছিল। কিন্তু এই ভাবনা আর নেই। এর বাজারের থলিতে এখন আছে রাজনীতি, ই-ব্যবসা, লাইফস্টাইল এবং আরও অনেক কিছু। আর আছে তথাকথিত মূল ধারার গণমাধ্যমের পাবলিকের কাছে যাওয়ার চেষ্টার কর্মকা-। অর্থাৎ বেশ মাল্টি স্টোরিড বাড়ির মতো- সবার জন্য বেশ আনন্দ বহনকারী পরিসর, লাভজনক তো বটেই। 

চার
সোশ্যাল মিডিয়ার তিনটি বড় পরিসর রয়েছে। ১. অর্থনৈতিক, ২. বিনোদন, ৩. রাজনীতি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এদের বিস্তার ঘটেছে বাধা বা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে গিয়ে। যেমন ব্যবসার প্রসার করতে গেলে বিজ্ঞাপন দরকার। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যম মানুষ দেখে কম এবং সেখানে বিজ্ঞাপনের রেট বেশি। তা ছাড়া অনলাইন ব্যবসা মানে দোকান নয়, ডিজিটাল ঠিকানা, তাই এটাই সুবিধাজনক ই-কমার্সের জন্য।

পাঁচ
রাজনীতির ক্ষেত্রে এর প্রসার ছিল আরও স্বাভাবিক। দেশে একাধিক নিয়ম চালু আছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা অ্যাক্ট ইত্যাদি। দেশের সীমানার মধ্যে থেকে অনেক কিছু বলা যায় না, করা যায় না। গালিগালাজ তো নয়ই, যেটা আমাদের পলিটিক্সের স্বাভাবিক ভাষা। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার চোরা সাইটে বা বিদেশ থেকে এসব বেশি হয়। আর এন্টারটেইনমেন্ট কনটেন্ট তো আছেই।

ছয়
অনেক ধরনের এন্টারটেইনমেন্ট আছে যেটা মূলধারায় কোনোদিন আসবে না। এটা ডকুমেন্টারি এবং ফিকশন উভয় ক্ষেত্রেই। তবে বিষয়গুলো কম বেশি এক। যৌনতা, পরকীয়া, বিভিন্ন যৌন কেলেঙ্ককারি নিয়ে অনেক নাটক, খুদে সিনেমা তৈরি হয়- যেগুলো লাখ লাখ ভিউ পায়। আর আছে বিস্তর ইসলামি কনটেন্ট। অর্থাৎ যেটা মানুষ খেতে চায় কিন্তু যা মূলধারায় পায় না, সোশ্যাল মিডিয়ায় সেটা পাওয়া যায় ভালোভাবে।

সাত
সোশ্যাল মিডিয়া মানে ফেসবুক মিডিয়া নয় শুধু, ইউটিউবও। সেখানে আছে হাজার কিসিমের কনটেন্ট। লেখা-পড়া শেখা, রুজি করার পথ, প্রেম-ভালোবাসা থেকে জোচ্চুরি, বাটপারি, খুন জখমের পাঁয়তারা সব। এই বিশাল দুনিয়া হয়ে গেছে একটি বিকল্প বাংলাদেশ। আমাদের সুশীল সমাজের পক্ষে ধারণা করাও সম্ভব না যে দেশের প্রকৃত অবস্থা দেখতে চাইলে সামাজিক গণমাধমেই গিয়ে খুঁজতে হবে। যে যেটা চায় সেটাই পাওয়া যায় সোশ্যাল মিডিয়াতে। তাই এর ভোক্তা বাহিনীর শেষ নেই। কিন্তু আমরা এই সম্পূর্ণ ধারণাটা জানার চেষ্টা করছি না, নাকি করতে চাই না কোনো কারণে?

আট
সামগ্রিক ধারণাটা কেন দরকার? কারণ এতে অনেক পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তিসঙ্গত তথ্যের ভিত্তিতে নয়। মানুষ জানে সবার ডিজিটাল প্রেসেন্স দরকার, কিন্তু সেটা কীভাবে হবে এটা তেমন জানা নেই। গত ৬ মাসে পাঁচটি ছোট-বড় পত্রিকা আমার সাথে যোগাযোগ করেছে তাদের ডিজিটাল পরিসর নিয়ে। কিন্তু কথা বলে মনে হয়েছে সবাই একটা জাদুর কাঠি খুঁজছে। লাভজনক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, যে তথ্য জানা দরকার, সেটা নয়। 

দেশের অর্ধেক মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া দেখে, এর মধ্যে প্রধান বৈষম্য হচ্ছে অর্থ-সামাজিক, তারপর লিঙ্গভিত্তিক। তবে যারা দেখে তাদের বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়ায় যায়। যত শিক্ষিত ততটাই এই ঘাটে নৌকা বাঁধে।

লাখ লাখ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রুজি করে নানা পথে। এটা কেবল ইন্টারনেট থেকে সরাসরি নয়, ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব থেকেও করে। এর ফলে একটি বড় নিবেদিত শ্রম শক্তি গড়ে উঠেছে।

অতএব পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন, দরকার টিকে থাকার পরিকল্পনা। আমরা চাই টিকে থাকতে, চাই লাভ করতে। কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনা ডিজিটালবান্ধব নয় এখনো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //