চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন সরকার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের পূর্বে তাদের ভবিষ্যৎ করণীয় জানিয়ে ইশতেহার প্রকাশ করে; কিন্তু এই ইশতেহার জনগণের মধ্যে সাড়া জাগায় না। কারণ তারা দলকানা, দল যাকে মনোনয়ন দেবে ভোটার তাকেই ভোট দেবে। শুধু তাই নয়, যারা বিভিন্ন মিডিয়ায় বিশ্লেষণ করেন তারাও রাজনৈতিক দলের বাইরে খুব বেশি চিন্তা করেন না। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার এবং যারা ‘ক্ষমতাধর’ তাদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণী দাখিল নিশ্চিত করা হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বিগত পনেরো বছরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে বলে দৃশ্যমান হয়নি। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রে উদ্ভূত ইস্যু মোকাবিলা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পৃথিবীর বহু প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরাগভাজন হয়েছে। এই সুযোগটি লুফে নিয়েছে বিএনপি। ড. ইউনূস গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার সবক দিয়েছেন, নারীর ওপর পুরুষের অনভিপ্রেত কর্তৃত্ব কিছুটা হলেও কমাতে পেরেছেন। তাই এ সম্পর্কিত অপ্রয়োজনীয় ইস্যু কমিয়ে ফেলা বাঞ্ছনীয়। 

বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন মেরুকরণে বাংলাদেশ সকল অংশী দেশকে তুষ্ট রাখতে পারছে না; পারা সম্ভবও নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকাতে গিয়ে আমেরিকা এক সময় পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে চীনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীনের অভূতপূর্ব উন্নতি আমেরিকার চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে চীনের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে; কিন্তু চীনের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সহ্য করতে পারছে না আমেরিকা। অথচ আমাদের উন্নয়নের গতি অপ্রতিহত রাখতে চীনের বিনিয়োগ অপরিহার্য। এমন সঙ্কটময় অবস্থা থেকে উত্তরণে আওয়ামী লীগ সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আরও বেশি কৌশলী কূটনীতির দ্বারস্থ হতে হবে। 

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে, দেশে সুশাসনের অভাব। আইনকানুনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন সব সরকারের আমলেই হয়েছে, প্রশাসন কোনো সরকারের আমলেই নিরপেক্ষ ছিল না। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এমন অবস্থার পক্ষে কলম ধরেছিলেন সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’-এর সম্পাদক শফিক রেহমান, তিনি আমেরিকার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেছিলেন, দলীয় সরকার পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে উঁচু পদের সব আমলার পরিবর্তন হয়ে যাওয়া শ্রেয়। শফিক রেহমানের যুক্তি মেনে নিয়েও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় যদি জ্ঞানহীন তোষামোদী লোকদের বাদ দিয়ে জ্ঞানী-গুণী ও সমৃদ্ধ নৈতিকতার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ঘুষ-দুর্নীতি কমে যাবে, ঘুষ-দুর্নীতি কমে গেলে অর্থ পাচারও কমে যাবে। এই শক্ত কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শক্ত হাতে করতে হবে। 

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কিছু প্রার্থীর ঘোষিত সম্পদ অবলোকন করে জনগণ স্তম্ভিত, এদের নিশ্চয়ই অঘোষিত সম্পদও আছে। পাঁচ বছর আগে একজন এমপির যে সম্পদ ছিল, তা এই নির্বাচনের সময় শত গুণ বেড়েছে। দলীয় পর্যায়ে এদের সততার মাত্রা পরিমাপ করে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হলে ঘুষখোরদের শিক্ষা হতো। আওয়ামী লীগের কাজ হবে জনসম্পৃক্ত ও জনদরদি নেতা তৈরি করা। 

নতুন সরকারকে মূল্যস্ফীতি কমানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ভর্তুকি দিলে উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য অর্থের ঘাটতি হবে, ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। 

অর্থের অভাবে উন্নয়ন কর্মকা- সীমিত করার সুযোগও নেই, উন্নয়ন কর্মকা- হ্রাস করা হলে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা প্রভৃতি সংস্থা থেকে স্বল্প সুদের ঋণ নিতে হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধির সব সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিলাস দ্রব্য আমদানি এবং বিভিন্ন কৌশলে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপিএল ক্রিকেটে বিদেশি খেলোয়াড়ের অন্তর্ভুক্তি কেন এই অবস্থায়ও অব্যাহত রাখতে হবে তা বুঝে আসে না। হুন্ডি ও অর্থ পাচার বন্ধ করা নতুন সরকারের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থে আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। খেলাপি ঋণগ্রহীতা কেন বাড়ছে তার কারণ অনুসন্ধান করে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি, এর পেছনে ঋণদাতার অনৈতিক যোগসাজশ বা অবহেলা থাকলে তাও বিবেচনায় নিতে হবে। তবে অর্থ পাচারের কারণে সৃষ্ট ঋণখেলাপিদের আলাদা করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং তফসিলি ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ কিনা তাও খুঁজে দেখতে হবে। 

-সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //