বিজয়ের ‘ওয়াজ’ কি শুধুই ডিসেম্বরের জন্য

ডিসেম্বর মাস সদ্য শেষ হলো। প্রতিবছরের মতো ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হলো। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণকবরগুলোর একটাকে স্মারক হিসেবে ধরে নিয়ে সেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরগুলো শ্রদ্ধা জানালো শহীদদের। বিশেষায়িত কিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম পৃথকভাবে স্মরণ হলো। সবকিছু মিলিয়ে বাস্তবতা এই যে, শ্রদ্ধার মিছিলের কলেবর সর্বত্রই কেমন কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। দেখে মনে হয় জাতি দিনটির গুরুত্ব ভুলে যাচ্ছে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে এখন শুধু পড়ে আছে একটু সামাজিক দায়িত্ববোধ আর আনুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা। সেই দায়িত্ববোধ কিংবা বাধ্যবাধকতা থেকেই বিভিন্ন স্থানে আলোচনা অনুষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হলো। প্রাণহীন এ সকল আয়োজনে শহীদ পরিবারগুলোর কথা কারও স্মরণে আছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। 

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে যশোরের আয়োজন দেখে ভাবনাগুলো আরও বেশি পোক্ত হলো। দিনের আলোচনায় কখনো শুধু বলতে হয় বলেই মুখস্থ কিছু নাম উচ্চারণ হলো, কখনোবা তাও নয়। উচ্চারিত নামগুলোও জাতীয় পর্যায়ের কিছু নাম। কেউ জানে না বা জানতেও চান না জেলা পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীদের নাম, ভূমিকা, অবস্থান, এমনকি শহীদ হওয়ার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম প্রামাণ্য দলিলে যশোরের ৯৫ জন বুদ্ধিজীবীর শহীদ হওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও হলফ করে বলতে পারি নেতৃত্বপর্যায়ের কেউ এলাকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম বলতে পারবেন না। দেশের প্রতিটি এলাকার চিত্র প্রায় একই। 

স্বাধীনতার পর পর বঙ্গবন্ধু বেশ কিছু শহীদ পরিবারকে ২০০০ টাকা এবং সঙ্গে একটা করে সান্ত¡না পত্র দিয়েছিলেন। অনেক শহীদ পরিবারের এই সামান্য সম্বলটুকুও নেই। গুটিকয়েক সৌভাগ্যবান এই সম্বল নিয়েই বেঁচে আছে। এদের সঙ্গে পরবর্তীকালে কেউ কখনো যোগাযোগ করছে এমনটাও শোনা যায় না। নিজের প্রিয়জনকে দেশের মাটিকে নিবেদন করল যে পরিবারগুলো, তাদের প্রতি আমরা আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করলাম দুই হাজার টাকা এবং একটা সনদ  দিয়ে! তা-ও সবার ভাগ্যে জুটল না। এর মধ্যে যেসব শহীদ পরিবারের সন্তানরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেতাদের বিষয় একরকম, আর যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে তাদের কথা অন্যরকম। এহেন দৃশ্যপটে দাঁড়িয়ে সরকার সার্বিক বিবেচনায় শহীদদের বিষয়টা কীভাবে দেখতে চায় সেটাই প্রধান কথা। 

পাঠকের মনে হতেই পারে ডিসেম্বর মাস তো শেষ। ২০২৩ সালের মতো স্বদেশের প্রতি সকল দায়িত্ব পালন সম্পন্ন হয়েছে। এখন আর এ লেখনীর প্রয়োজন কোথায়। কিন্তু ভেবে দেখা প্রয়োজন দিনে দিনে আমরা কি নিজেদের কৃতঘ্ন মানুষ হিসেবে প্রতীয়মান করছি না? অন্য কিছু বাদ দিলেও যদি ১৯৭২ সালে ফিরে যাই, তাহলেও ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের মধ্যে পরাধীনতা ছিল। সদ্য স্বাধীন দেশেও হারিয়ে গিয়েছিল অমূল্য মেধার মানুষেরা। তাই তো এ বিষয়ে লেখনীর আবেদন থাকা প্রয়োজন সর্বসময়।

২০২১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নবতর সংযোজিত সংজ্ঞায়ও সেই প্রতিফলন আমরা পাই। সেখানে বলা হয়েছে “১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্র শিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী।” সরকারি হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বাংলাপিডিয়ার তথ্য মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। তবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত হিসেব বের করা গেলে ২০২১ সালের সংজ্ঞায়ন মোতাবেক সে সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে তা নিশ্চিত করে বলা চলে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও পূর্ণাঙ্গ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা না পাওয়া জাতির জন্য লজ্জাজনক। যদিও মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর গত কয়েক বছর ধরে এলাকাভিত্তিক যে কার্যক্রম শুরু করেছে তা শহীদ পরিবারগুলোকে আশাবাদী করে তুলেছে। জানি না কবে এই সমীক্ষা শেষ হয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সম্ভব হবে।

সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা তার নীতিমালা তৈরি করে দিয়েছে। তবে তালিকা করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অনেকে প্রশ্ন করতে পারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে লাভ কী? গ্রাম্য প্রবাদ আছে- “যেচে শাল পল গাঁদায় নেয়া” এমন একটা ব্যাপার হয়ে যাবে আর কি। যেমনটা ঘটেছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে গিয়ে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা হিসেবে বেশ কিছু সুবিধাসহ আর্থিক অনুদান দেওয়া যখন শুরু হয়, তখন অনেকের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে নিজ নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য। মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। ফলশ্রুতিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনুগ্রহ আদায় করে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা যেমন হয়েছে, বিপরীতে সত্যিকার যারা মাঠে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছে তাদের অনেকেই এখনো তালিকার বাইরে আছে। সংখ্যাবৃদ্ধির কাজ যেভাবে এগিয়ে চলছে তাতে ১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া কেউও যদি মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়ে যায় তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার কোনো রকম তাগিদ কেউ অনুভব করে না। অথচ দেশের স্বাধীনতায় শহীদ পরিবারগুলোর প্রধান এবং উপার্জনক্ষম মানুষটির সামান্য হলেও অবদান আছে। 

আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট) অধ্যক্ষ সুলতানউদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন, কিন্তু বুদ্ধিজীবী ছিলেন কিনা তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ জানে না বা ওনার পরিচয়ও জানেন না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধ্যক্ষদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কিনা তাও জানি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ছাত্রাবাসটি শহীদ অধ্যক্ষের নামে উৎসর্গ করে দায়িত্ব শেষ করেছে। ছাত্রাবাসের নাম উচ্চারণ করতে গিয়েই শুধু শহীদ অধ্যক্ষের কথা স্মরণ করা হয়। এ ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারী অধ্যক্ষের নাম আর কোনোভাবেই সারা বছর উচ্চারিত হয় না। প্রতিবছর নীরবে ৫ এপ্রিল পার হয়ে যায়। শহীদ অধ্যক্ষের বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে জানানোর মতো নথিপত্রও পাওয়া যায় না। শহীদদের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ এই পর্যায়ে আছে। একজন অধ্যক্ষ হলেও দায়িত্ববোধের কোনো পৃথক অবস্থায় আমরা নেই। 

বর্তমানে দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশ ও জাতির কল্যাণে বুদ্ধিজীবীদের খুব একটা প্রয়োজনীয়তা আছে বলে অনুভব হয় না। দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরাও রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর বাংলাদেশের মসনদ কোনোভাবে নিজ দলের মতাদর্শে বিশ্বাসীদের ছাড়া ভিন্ন মতাদর্শের কারও কথা শুনতে চায় না। ১৯৭১ সালের সময়কালে জনসাধারণ যাদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে জানতো এবং মানতো তারা তাদের মতামত দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনায় সুস্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করতেন। কে কী ভাববে, কীভাবে বিষয়টা নেবে, কার স্বার্থ রক্ষা হবে বা হবে না সেসব কোনো বিবেচনার মধ্যে ছিল না। আর এখনকার বুদ্ধিজীবী বাতাস বুঝে ছাতা ধরেন। ব্যতিক্রম যারা তারাও নীরব থেকে নিজেদের সম্মান রক্ষা করে চলেছেন। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা সরকারি উদ্যোগে হবে এমন আশা করা যায় কি? মনে রাখা প্রয়োজন; সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় বারংবার তারিখ ঘোষণার পর আজ পর্যন্ত রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে পারেননি কিংবা করেননি। স্থানীয়ভাবে যাদের নাম রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির তালিকায় থাকার কথা, তাদের পরিবারের অনেকেই নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে ব্যস্ত। 

তবে আমাদের জাতিগত মুক্তির পথ একটাই, ইতিহাসের নবস্ফুরণ। জনমানুষের ইতিহাসকে তুলে আনার প্রচেষ্টাকে বেগবান করতে হবে। নইলে উত্তরণ হবে না। আমরা যদি আমাদের পিতৃপুরুষের গর্বিত আত্মত্যাগের কথা না জানি, তাহলে ধীরে ধীরে ম্লান নহবে আলোকময় দিনের স্বপ্ন। 

জনগণের প্রত্যাশা ১৯৭১ সালের মতো আজো দেশের বুদ্ধিজীবীরা সামগ্রিক সামাজিক জীবন সুরক্ষায় সত্য সন্ধানে ব্রতী হবেন। মিথ্যার আবর্জনা মুক্ত করে সত্যকে চোখের সামনে তুলে ধরতে আত্মনিয়োগ করবেন। নিমগ্ন থাকবেন আজকের সামাজিক বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, পরিবারতন্ত্র, গোষ্ঠীস্বার্থ ইত্যাদি থেকে জাতিকে মুক্ত করে যৌক্তিক জীবনে বহুজনের কল্যাণে সংযত জীবন উপভোগে। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্তি ব্যক্তিস্বার্থ বা সর্বোচ্চ গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে পারে মাত্র এ বিষয়টি সকলেরই বোধে থাকা প্রয়োজন।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //