ইউনিভার্সিটি জীবন এবং ঠুন মামি, মামা

অনুষ্ঠানটি আমার বিয়ের মুখে মিষ্টি দেওয়া। পূর্ববঙ্গের কালচারে একে কী বলে জানি না, কারণ আমার মা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা, তাই অনেক অনুষ্ঠানের নাম ওই দিককার ভাষায়। যা-ই হোক আমার ও-রকম একটা অনুষ্ঠান হলো। কী আর করা, সহ্য করতে হলো। আমি বসলাম গিয়ে আর লোকজন এসে আমাকে এক চামচ ক্ষীর/মিষ্টি দিল আর কপালে গালে হলুদ। এই অনুষ্ঠান সাধারণত শুরু করেন ছেলের মা। সবাই আমার মাকে আসতে বললেন সামনে। কিন্তু আমার মা, উপস্থিত ঠুন মামিকে বললেন, ‘আপনি প্রথমে যান। আপনাকে নিজের মায়ের মতো মানে।’ ঠুন মামি আমার রক্তের কোনো আত্মীয় নন, আমার শিক্ষকের স্ত্রী, আমার গুরুপত্নী। আমি আসলেই তাকে ওই স্থানে দেখতাম। যদিও তিনি হয়তো আমার দুই তিন বছরের বড়, কিন্তু সম্পর্কটা মাতার। আমার জীবনের যত অর্জন তার সবই যেন সম্পর্ককে ঘিরে।

দুই.
এই পত্রিকার কয়েকটি লেখায় আমি ৭০ দশকের মেজাজটা বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। গোটা সমাজ একটি বিশেষ তালে বা ভঙ্গিমায় চলে যেটা সেই সময়ের সিগনেচার। কিন্তু তার পেছনে কিছু আর্থ-সামাজিক কারণ থাকে। সেগুলোকে চিনতে না পারলে তখনকার সময়কেও ধরা যাবে না। সত্তর দশকটা সবচেয়ে জটিল, কারণ এটি ষাট ও আশির মাঝামাঝি দশক। সবচেয়ে ক্রান্তিকাল এই দশক। একটি স্বাধীন দেশের প্রথম দশক, সে দিক থেকেও এটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একই সঙ্গে সেই রাষ্ট্রের পরিচিতি নির্মাণের যে মাল মসলাটা স্থাপিত হয় কেবল তখনই দেখা যায় নয়া রাষ্ট্রের আপন চেহারা। সেই দিক থেকে এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন দশক বলা যায় এবং আমরা সেই দশকে বড় হই। ভালো হোক মন্দ হোক আমি সেই দশকে নির্মিত মানুষ, যদিও বয়স তখন ১৮ পার করেছি। কিন্তু একাত্তর যেন ছিল নব জন্ম। সত্তর দশক ছিল আমাদের মাতৃদশক।

তিন.
আমি ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই। প্রথম দিনেই পরিচয়। বন্ধুত্ব হয় আবরার চৌধুরীর সঙ্গে, যে পরে ইউনিভার্সিটিতে টিচার হয়। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামাল স্যারের। আবরারের মামার বন্ধু, সেই সূত্রে মামা, কিছুদিনের মধ্যে আমারও কামাল মামা। আর তার স্ত্রী মামি, খুব সরল হিসাব। মামির ভাইও খুব নাম করা শিক্ষক, ইকোনমিক্স বিভাগের স্বপন আদনান স্যার। তাদের জীবনের অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। আমাদেরও তাই। কামাল স্যার থাকতেন ক্যাম্পাসে সাব-লেট বাসায়, একটা রুমে। সেটাই পরিণত হতো হরেক রকম মানুষের আড্ডাখানায়। পরে ইংরেজির অধ্যাপক সবার প্রিয় কাশীনাথ রায় জগন্নাথ হলের টিউটর হলেন, একটু বড় বাসা তাতে ওঠেন। মামা, মামির নতুন ডেরা, আর তার সঙ্গে গোটা আড্ডাখানা।

চার.
স্যারের বাসায় যারা আসতেন তারা অনেকেই চীনা বামপন্থি রাজনীতির মানুষ। দু-একজন অন্য ঘরানার মানুষ আসত, সবার সঙ্গে সবার আড্ডা হতো। এই তফাতের অভাবটা আমার খুব ভালো লাগত। কামাল স্যার ভীষণ অতিথিপরায়ণ মানুষ ছিলেন। কত মানুষ যে আসত, চা বিস্কুট খেত। মাঝে মাঝে ভাবতাম, স্যারের বাবা তো রাজনীতির মানুষ- আওয়ামী লীগ করেছেন এককালে- এই মজলিশি অভ্যাস যাবে কই? তবে আয়োজনটা করতেন ঠুন মামি।

পাঁচ.
বাড়িতে আড্ডা দেওয়ার আরও মানুষ ছিল। উনাদের মেয়ে ‘বুড়ি’- সিঁথি কামাল, এখন আমেরিকায় থাকে। আর মামির দুই বোন। আমি ওদের গল্প শোনাতাম অর্থাৎ দুইটা আড্ডা চলত দুই আলাদা ঘরে। আজকাল ভাবি আমার কত সন্ধ্যা গেছে, গল্প বলে যাদের ক্ষুধা মিটতই না- একটা দুইটা গল্পে। আসর শেষ হলে সিঁথি গলায় ঝুলে থাকত, যেতে দিতে চাইত না। আমি জানি না, এই ট্রাফিক জ্যামের দুনিয়ায় এ রকম সম্পর্কগুলো তৈরি হয় কিনা যেখানে ছাত্র গল্প বলে বাচ্চা মেয়েদের স্যারের বাসায়, মা মাঝে মাঝে এসে খবর নেয় আর স্যার নিজের আড্ডায়।

ছয়.
আমি কোনোদিনই দলে ভেড়া মানুষ হতে পারলাম না। আমার সবার সঙ্গে খাতির হতো। সেই দিক থেকে আমি কিছুটা ষাটের দশকের মানুষ, যখন রাজনৈতিক শত্রুতা এত তীব্র ছিল না। মস্কোপন্থি বা জাসদের সমর্থকদের সঙ্গেও আমার খাতির ছিল। এরা একে অন্যকে অপছন্দ করত। আমার সংস্কৃতি সংসদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। এতে অন্যরা অখুশি। আর একবার এক জাসদ কর্মীকে চীনাদের কালচারাল অনুষ্ঠানে দাওয়াত করে দুই পক্ষের গালি খাই। অর্থাৎ প্রথম দশকেই আজকের এই গণবিদ্বেষের মনোভাব তৈরি হচ্ছিল। তবে আমি মার্ক্সবাদ নিয়ে প্রচুর পড়তাম। মুখ ভর্তি দাড়ি, ঠোঁটে মার্ক্স, একজন বলে, ‘বাউল মার্ক্সিস্ট’। 

সাত.
কামাল স্যার আর ঠুন মামিকে কত বিরক্ত করেছি আমি, আমরা বলতে পারব না। আজকে সেসব মনে পড়লে লজ্জা লাগে, কিন্তু কী করা? এমন একটা স্নেহের পরশ পেতাম যে বারবার যেতাম। একদিন মনে আছে আমি আর আবরার মেঝেতে বসে মামির সঙ্গে কথা বলছি। এমন সময় উনার কাছে কোনো আত্মীয় আসেন। আমরা কারা জিজ্ঞাসা করলে উনি বলেন, ‘আর কী বলব! এই দুইটা আমার সাওয়াল। বড় হইছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে কিন্তু।’ আজও আমার স্মৃতিতে ওই মুহূর্তটা বেঁচে আছে, থাকবে আমৃত্যু। 

আট.
কেমন করে ওই দিনগুলো পার করলাম মনে নেই, তবে একদিন আমরা আর ছাত্র রইলাম না। রেজাল্ট হওয়ার আগেই চাকরি পেলাম- মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস প্রকল্প। বিয়ে করলাম, সংসার শুরু করলাম। দু-এক বছর পর জীবনে ব্যস্ততা বাড়ল প্রচ-ভাবে। আমার জীবন অস্থির, বেশিরভাগ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয় মাস্টার না হয় সরকারি চাকুরে, আর আমি এটা থেকে ওটা, ওটা থেকে আর একটা, পাগলা পাখির মতো আকাশে উড়ি, অস্থির। শুধু স্থিরতা ইতিহাস চর্চায়। আর জানি আমাদের বা আমার কালে কামাল স্যার ও ঠুন মামির পরিবারে সান্নিধ্য আর স্নেহ পেয়েছি, পেয়েছি আবরার ও অন্যদের মতো বন্ধু। যথেষ্ট। আমার ডালা পূর্ণ। 

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //