বিজয়ের আনন্দ আমাকে স্পর্শ করে না

বাংলাদেশের ৫৩তম বিজয় দিবস উদযাপিত হলো, কিন্তু বিজয়ের আনন্দ যতটুকু পাওয়ার কথা ততটুকু পেলাম না। কারণ এই বিজয় ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, সাম্প্রদায়িক শক্তি মজা করে ভোগ করছে। আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে একনাগাড়ে ক্ষমতায়, কিন্তু ঘুষ, দুর্নীতি আর সাম্প্রদায়িক সংঘাত রোধ করতে পারেনি। আমার ভাতিজা ড. শামীম আহমেদ জিতু মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের পক্ষের একজন সোচ্চার লেখক, সম্প্রতি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও দেশে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে কেউ সিগন্যাল মানে না, যত্রতত্র অকারণে হর্ন বাজায়, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে, কুকুর বিড়ালদের ওপর নির্যাতন করে, ৫০টি টিভি চ্যানেলে বস্তাপচা নিম্নমানের অনুষ্ঠান, একজন সাংবাদিকও শুদ্ধ ভাষায় সাবলীলভাবে রিপোর্ট কাভার করতে পারে না, দোকানে দোকানে মানুষ ঠকানোর ফাঁদ, খাবারে ভেজাল, কট্টর ধার্মিক ও অমানুষের সংখ্যা প্রতিযোগিতা করে বৃদ্ধি পাচ্ছে- ৫২ বছর বয়স্ক একটা দেশের জন্য এগুলো ভালো কিছু নয়। 

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এখনো গণতন্ত্র বা একটি জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থার কাঠামো তৈরি হলো না; ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যা, গুজব, অর্থ পাচার বন্ধ হলো না। পাকিস্তান আমলে বিরোধী দলের নেতা হোসেন শহীদ সোহওরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুকে ভারতের দালাল বলে অভিহিত করা হতো। সোহওরাওয়ার্দীকে ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর’ বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে হেয় করা হতো। এখন পাকিস্তানপন্থি এবং চীনপন্থিরা পাকিস্তানিদের সুরে সুর মিলিয়ে বলে যাচ্ছে ‘আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল’। চীনপন্থিদের প্রভু-রাষ্ট্র চীন একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় তারাও ভারতবিরোধী। পাকিস্তান যেহেতু দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট সেহেতু কিছু লোক পাকিস্তান ও ইসলামকে এখনো সমার্থক মনে করেন। পাকিস্তান দ্বারা প্রভাবিত এই গোষ্ঠীটি স্বভাবতই আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী। এদের কোনো রাজনৈতিক আদর্শ নেই, একটাই আদর্শ ভারত-বিরোধিতা। রাজনৈতিক কারণে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এখনো নানা ধরনের ঘৃণা, বিদ্বেষ জিইয়ে রাখা হয়েছে। সস্তা জনপ্রিয়তা লাভে এখনো মসজিদ আর পূজাম-প ভাঙা হয়, এখনো মাজার শরীফ থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়, নির্বাচনে জয়ী হয়ে ওমরাহ পালন করা হয়। এখনো রাজনীতিবিদ এমএ হান্নানের নাম ছেঁটে ফেলে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নামকরণ হয় ‘শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে একইভাবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দিয়ে ঢাকার বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয় ‘হযরত শাহ্‌জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। এখানেও ধর্মীয় কৌশল, এমন দুজন ধর্মীয় গুরুর নাম বিমানবন্দরের সঙ্গে জড়ানো হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ নাম পরিবর্তন করার সাহস না করে। ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় থাকার কৌশল সব রাজনৈতিক দলই অবলম্বন করেছে-----জিয়াউর রহমান সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ যোগ করেছেন এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছেন। বর্তমান সরকার জনগণের দাবি ছাড়াই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য উপাসনালয় করে দিচ্ছে। উপাসনালয় গড়ে উঠবে সৎ মানুষের বৈধ টাকায়, সরকারের অনুদান বা ভোট প্রার্থীর অবৈধ টাকায় নয়। 

স্বাধীনতা-উত্তর সরকারগুলোর চরম ব্যর্থতায় দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা শিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে না। যারা এককালে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন তাদেরই নাতিপুতি সন্তানেরা তাদের সমান্তরালে মাদ্রাসা তৈরি করে যাচ্ছেন। গণতন্ত্রের একটি বিরাট কুফল হচ্ছে, ভোটের প্রত্যাশায় আস্তিক-নাস্তিক-ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ সবাই নির্বাচনের সময় অকাতরে মাদ্রাসায় দান করে থাকেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষও বাছবিচার না করে সেই দান প্রফুল্ল চিত্তে গ্রহণ করেন। ভোটের মাঠে এরা একটি বিরাট প্রেসার গ্রুপ, এদের প্রেসারে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন হয়, শিক্ষাগত ডিগ্রির মর্যাদা বেড়ে যায়। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রশক্তি ছিল সাম্প্রদায়িক, আর বাংলাদেশ আমলে রাষ্ট্রশক্তির প্রশ্রয়ে জিইয়ে আছে সাম্প্রদায়িকতা। বিএনপি আমলে বাংলাদেশ টানা পাঁচ বছর দুর্নীতিতে ছিল চ্যাম্পিয়ন। আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা টাকা ফেরত আনা হয়েছে, নাইকো দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন কানাডার এক পুলিশ কর্মকর্তা। মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে ঘুষ ও মানি লন্ডারিং নিয়ে তদন্ত করেছে এবং বাংলাদেশের আদালতে তার বিরুদ্ধে এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন এফবিআইয়ের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি। জাতীয় পার্টির এরশাদ সাহেব শুধু নিজে দুর্নীতি করেননি, অন্যকেও দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে একটি বিদেশি পত্রিকায় তার সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘গরিব দেশের ধনী প্রেসিডেন্ট’। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির মাপকাঠিতে দেশের অবস্থান ‘চ্যাম্পিয়ন’ না হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘুষ আর দুর্নীতির ছড়াছড়ি জনগণকে হতাশ করেছে। কানাডার বেগম পাড়া এবং অর্থ পাচারের গল্প-গুজবের রম্য রচনা মানুষ কান পেতে শুনছে, বিশ্বাস করছে, সত্যাসত্য বের হবে ক্ষমতা হারানোর পর। সরকারি অফিসে কাজ না করা এবং সেবার নামে গ্রাহক নিপীড়নের একটি গল্প বলি। 

গ্যাস অফিস থেকে আমার স্ত্রীর মোবাইলে একটি এসএমএস আসে, তাতে লেখা ছিল, ‘আপনার কাছে পাওনা ৫২ হাজার টাকা নির্ধারিত তারিখের মধ্যে পরিশোধ না করলে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।’ আলাপ করলাম তিতাস গ্যাস কোম্পানির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে, তিনি বললেন, ‘দ্রুত পরিশোধ করুন, নতুবা সংযোগ একবার বিচ্ছিন্ন করা হলে তা বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া পুনর্স্থাপন হবে না।’ ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি আমাদের সংশ্লিষ্ট গ্যাস অফিসের এক উপমহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমার বয়স সত্তর, তবু তড়িঘড়ি করে নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ পাশের গ্যাস অফিসে গেলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, তিন বছর আগের ৩১ হাজার এবং পনেরো হাজার পাঁচশ টাকার দুটি বিল আমি পরিশোধ করিনি। কিন্তু উক্ত টাকার দুটি পরিশোধিত বিল দেখিয়েও নিস্তার পেলাম না। তাদের যুক্তি, ওয়ান ব্যাংক এবং বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধিত বিল তারা পায়নি। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওয়ান ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে নিশ্চিত হলাম যে, ৩১ হাজার টাকা ওয়ান ব্যাংক গ্যাস অফিসের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছে তিন বছর আগে, প্রমাণক হিসেবে গ্যাস অফিসের সার্ভার থেকে বের করা একটি স্টেটমেন্ট আমার হাতে দিল। বিকাশের এজেন্ট আমার গ্যাস বিলে সিল স্বাক্ষর দিলেও তারা যে টাকা পাঠায়নি তা বুঝতে পারলাম। ওয়ান ব্যাংকের স্টেটমেন্টটি নিয়ে পরদিন আবার গ্যাস অফিসে ছুটলাম, গ্যাস অফিসের এক কথা, তারা টাকা পায়নি, তাই দায় আমার। ঊর্ধ্বতন অফিসারের চেয়ে করণিকের দাপট বেশি। মনিটরিং নেই, কেন তিন বছর যাবৎ পাওনা এবং প্রাপ্তির মধ্যে সমন্বয় হলো না তার কোনো জবাব নেই। তিন বছর পূর্বে গ্যাস বিল পরিশোধ করার পরও আমাকে বিলম্বে পরিশোধের কারণে জরিমানা দিতে হলো। সরকারের টাকা পরিশোধ করতে গেলেও গ্রাহকদের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নাজেহাল হতে হয়। 

শুধু সেবা প্রতিষ্ঠান কেন, দেশের প্রতিটি সেক্টরে একই অবস্থা। পয়সা খরচ করে সেবা নিতে গিয়ে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নতজানু হয়ে কথা বলতে হয়, সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করাতে গেলে দাসানুদাস হতে হয়। প্রতিবছর নাকি ১৫ লাখ রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজন ভারত সফর করে, তাদের ভ্রমণ সহজ ও আরামদায়ক করার জন্য বাস, ট্রেন, বিমান সংযোগ বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু দেশের ভেতর চিকিৎসা নিশ্চিত করার গরজ কারও নেই। শুধু মন্ত্রী, আমলা নয়, বিরোধী দলের নেতারাও দেশের চিকিৎসার ওপর আস্থা রাখেন না, ছোটেন বিদেশে। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, হোটেল, বিমানবন্দর কোথাও গ্রাহকদের সঙ্গে বেতনভুক কর্মচারীরা ভালো ব্যবহার করেন না। এখনো বিমানবন্দরে যাত্রীর মালামাল চুরি হয়, গুরুত্বহীন প্রকল্পে অর্থ ব্যয় হয়, প্রকল্প পরিচালক দুটি গাড়ি ব্যবহার করেন, ইচ্ছাকৃত বিলম্ব ঘটিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি হয়, সরকারি কর্মকর্তা গুরুত্বহীন কাজে বিদেশে যায়, এখনো বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হয়নি। তাই বিজয়ের আনুষ্ঠানিকতার আনন্দ আমাকে আজ আর স্পর্শ করে না।

-সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //