মুক্তি কোথায়

দেশের এক উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের বাসিন্দা। অল্প কিছু জমির মালিক, তাতেই কৃষিকাজ করে জীবন নির্বাহ। গ্রামের কৃষিতে আধুনিকতার পরশ বলতে রাসায়নিক সার আর কীটনাশক। নদীর পাশে গ্রাম হওয়ায় নিজে একটা শ্যালো মেশিন বসিয়ে সেচের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ২ কিলোমিটার আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ৩ কিলোমিটারের বেশি যেতে হয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার আলো সেভাবে পরিবারে আনতে পারেননি। একদিন এক চিকিৎসকের অপেক্ষায় থাকাকালীন তার সঙ্গে পরিচয়। গ্রামের এই সহজ সরল মানুষটার একটা অপূর্ব মন আছে যা থেকে মনে হয় মানুষকে তিনি সহজেই আপন করে নিতে পারেন। তাই পরিচিত হওয়ার পর থেকে জেলা সদরে আসলেই যোগাযোগ করেন, সময় পেলে দেখা না করে যান না। 

ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করতে বসলেই আরজ আলী মাতব্বরের কথা মনে পড়ে। আরজ আলী মাতব্বর, শিক্ষা বঞ্চিত একজন মানুষ- যিনি জীবন সংগ্রামের মধ্যে থেকে শুধু ইচ্ছার জোরে চিন্তাকে গভীর থেকে গভীরে নিয়ে গিয়েছেন। ঠিক তেমনি স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, জীবন সংগ্রাম, আগামী প্রজন্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে আমার পরিচিত ভদ্রলোকটি নিজের ভাবনার কথা যখন তুলে ধরেন তখন অবাক হয়ে শুনতে হয়। কিছুদিন আগে হঠাৎ বেশ সকালে ভদ্রলোক এসে হাজির। ঘরে বসেই বললেন আজ তার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমি তো হতবিহ্বল। নিজের যোগ্যতা-বুদ্ধি-জ্ঞান-মেধার ওপর যার আস্থা নেই সে কীভাবে এই গভীর বোধসম্পন্ন মানুষটির প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে? মজার ব্যাপার হলো আমার সম্মতির অপেক্ষা না করে প্রতিদিনের মতো তিনি বলতে শুরু করলেন, আমরা কি স্বাধীন হয়েছি, আমরা কি মুক্তিযুদ্ধ করেছি? প্রশ্নের ধরন বুঝে ইচ্ছে করেই কথার মাঝে জানতে চাই স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করে এসে এমন প্রশ্ন কেন মনে হচ্ছে? তিনি আক্ষেপের সুরে বললেন- দেশের দিকে, মানুষের দিকে তাকালে মনের মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মে কত প্রশ্ন জাগে তার হিসেব করতে পারি না।

ভদ্রলোকের কথায় ভাবতে বসলাম। সত্যিই একটা সময় ছিল যখন দেশে জমিদারদের বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে, জুতা পরে যাওয়া যেত না। খাজনা আদায়ের নামে ধরে নিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারা হতো প্রজাদের। এ ছাড়াও আরও অনেক ধরনের অত্যাচার চলত। জমিদারি রক্ষার জন্য জমিদারদের খাজনা নিতে হতো, বদলে জমিদাররা জনকল্যাণের কাজ করত, তবে তা একান্তভাবেই নিজের চিন্তা-চেতনা মতো। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দেশে কী এ অবস্থার সত্যিই কোনো পরিবর্তন এসেছে? এখনো তো পাড়া-মহল্লায় রাজার দায়িত্ব ধরে রাখার জন্য মরিয়া মানুষের প্রতিযোগিতা দেখি। এরা জমিদার থেকে অনেক অনেক সরেস, কয়েক কাঠি উপরে, ভাত দেবার ক্ষমতা না থাকলেও কিল মারার গোঁসাই। রাজত্ব রক্ষার প্রয়োজনে এরা দলের কাউকেই ছাড় দেয় না, আর বিরোধীদের কথা তো বাদই দিলাম। দেশে জমিদারি প্রথার বিলোপ হলেও মানুষ কি এই রাজাদের হাতে আরও কঠিন অত্যাচার ভোগ করছে না? গ্রাম বা শহর যেখানেই হোক কয়েক দিন থাকলেই দেখতে পাওয়া যাবে নব্য এসব রাজার কাজকর্ম। 

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫২ বছর, কিন্তু প্রশাসনে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি? প্রশাসকরা কী করতে পারে আর কী পারে না তা যেমন বোঝার বাইরে ঠিক তেমনি কী জানে না, আর কী জানে তা-ও বোধগম্য নয়। সরকারের শত শত কমিটির প্রধান হওয়া থেকেই এদের ক্ষমতার পরিসীমা দেখা যায়। প্রতিবার নতুন নতুন ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভাগীদার হয়ে চলেছে এ বাহিনী। কী অসীম কর্মশক্তি এদের। এই যেমন বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান। সবচাইতে মজার বিষয়, প্রজাতন্ত্রের মালিক যাদের বলা হয়ে থাকে তাদের কোনো অধিকার এ দেশে নেই। সেই অধিকার বরং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের। আর আজও প্রশাসনের করাতের দাঁত রয়ে গিয়েছে। স্বজাতির শাসন যখন কোনো পরিবর্তন আনতে পারল না তখন এ ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে এমন লক্ষণও আশা করা চলে না, বরং দিনে দিনে কর্মচারীদের ক্ষমতা অনেক বেশি পাকা হচ্ছে, স্যার-ম্যাডাম না বললেই তারা অনাসৃষ্টি শুরু করে দেয়। 

সুদূর অতীত থেকে আমাদের এ ভূখণ্ডে বিদেশিরা এসেছে, সম্পদ লুট করেছে, শোষণ করেছে। তাই মনে করি বিদেশি ঋণ বা অনুদানের টাকায় দেশের জনগণের হক আছে। কিন্তু তাই বলে জুট মিল বন্ধ করার শর্তে রাজধানীর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ঋণ নিতে হবে? লোকসানের অজুহাতে একটার পর একটা বৃহৎ শিল্প বন্ধ করে দিতে হবে, বিক্রি করে দিতে হবে? 

এখন তো আবার মেগা প্রকল্পের যুগ। তাই চলমান প্রকল্পের পাশাপাশি প্রস্তাবিত মেগা প্রকল্প দেশের বর্তমান পর্যায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনার দাবি রাখে। যদিও ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরা বলতেই পারেন ক্ষমতা আমার, স্বপ্ন দেখার অধিকারও আমার। এখানে জনগণের কোনো ভূমিকা নেই। এই যেমন তারা বলছেন পদ্মা সেতুতে কত মানুষের উপকার হয়েছে তাই দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করতেই হবে। আসলে দেশ, জনগণ, পরিবেশ কী চায়, সর্বোপরি এই ভূখ- সৃষ্টিকারী নদী কী চায় তা বিবেচনার কোনো প্রয়োজন কেউ অনুভব করতে চায় না। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে মেগা প্রকল্পের আস্ফালনই বড়। অথচ ছোট ছোট কত বিষয় আছে সেগুলোকে প্রকল্পের আওতায় আনা হলে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতো, বেকারত্ব ঘুচত, অর্থনৈতিক ভিত মজবুত হতো, গ্রাম-শহরের বৈষম্য কমত, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হতো তার ইয়াত্তা নেই। 

দেশের সব মানুষের মনে আলো জ্বালাতে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ও কাজ করে খাওয়ার শক্তি অর্জনের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা দরকার। সবচাইতে দরকারি এই দুটো ক্ষেত্রই আজ সবচেয়ে অবহেলিত। শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্যই সমাজ ও দেশকে বৈষম্যে জড়িয়ে ফেলেছে। আমাদের বিত্তবান বা অভিজাত সমাজের মানুষেরা যদি কোনো কারণে নিজের গ্রামকে মনে রাখেন তাহলে গ্রামে উপাসনালয়, এতিমখানা বা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেন, কিন্তু ভুলেও প্রাথমিক বিদ্যালয় করার কথা মনে করেন না। মানুষ আলোকিত মানুষ হলে যে এসব মানুষের স্বরূপ প্রকাশ পেয়ে যাবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও এর বাইরে আসতে পেরেছে বলে মনে করি না। দেশে পরিমাণগত শিক্ষার উন্নয়ন ঘটলেও শিক্ষার মান প্রশ্নসাপেক্ষ। শিক্ষা মানহীন হয়ে পড়ার কারণে গ্রামবাংলার মানুষ আজ সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার। দেশের সব উন্নয়ন শহরের প্রান্তে এসে থেকে গিয়েছে, গ্রামে প্রবেশ করেনি। 

ভাবনার এ পর্যায়ে সম্বিত ফিরলো। শুনলাম ভদ্রলোক আক্ষেপ করছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম, জীবনবাজি রেখে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করলাম কিন্তু মুক্তি কোথায়? আমাদের মুক্তি কি তবে স্বজাতির শাসনের মধ্যে সীমিত? শুধু নিজের অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতার মধ্যে আটকে পড়া? মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শহুরে মানুষের জন্য গ্রামবাংলার মানুষের যে অভাবনীয় সহযোগিতা সে কথা কেউ মনে রাখেনি। শহরের শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্যের ব্যবস্থা, লুকাতে সাহায্য করতে গিয়ে কত পরিবারের সদস্যরা গুলি খেয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে, পালিয়ে বেড়িয়েছে, কত মানুষের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী আমরা কি তাদের কথা মনে রেখেছি, যোগাযোগ রেখেছি, বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি? 

আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলি, নামের আগে বীর লিখি, চেতনার কথা বলি। কিন্তু চেতনা বাস্তবায়নের জন্য কিছু করি তেমনটা দৃশ্যমান করে তুলতে পেরেছি বলে মনে হয় না। শুধু সরকারি সম্মানী পেয়ে নিজে রাজকীয় জীবনযাপন করছি। 

ভদ্রলোককে বললাম এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে কেন অনেক জ্ঞানী-গুণী বিশিষ্ট জনের কাছে আছে বলে মনে হয় না। সর্বশ্রেণির পেশাজীবীরা রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে যা করা দরকার, বলা দরকার তার ধারে কাছে যেতেও রাজি নয়। পেশার উন্নয়নের চাইতে তারা রাজনৈতিক দলের কর্মকা-ে নিবেদিত অনেক অনেক বেশি। স্বাধীনতা চিরকালের বিবেচনা করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্রতী হওয়া লোকের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এতে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র, ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ার ধস, সিন্ডিকেট ব্যবসা ইত্যাদির রমরমা ক্ষেত্র প্রস্তুত। এখন মাটি মানুষের কথা আস্ফালনের মধ্যে রেখে দেশকে তারা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেশকে বিশ্বের রোল মডেল দাবি করা হলেও জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের বিষয় উপেক্ষিতই থেকে গেছে। মানুষ এখন নিজে বাঁচলে বাপের নাম বিষয়ে প্রতিযোগিতার মধ্যে আছে; তাই সব করাও যাবে না, আর উত্তর পাওয়ার চেষ্টা নিজের পায়ে কুড়াল মারার সমতুল্য।

লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //