বিরোধী দল দরকার কেন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কী  হবে- তা সবার জানা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। নৌকার প্রার্থীরা যে দুই শতাধিক আসনে জয় পাবেন, সেটিও আন্দাজ করা যাচ্ছে।

জাতীয় পার্টিকে ২৬টি এবং শরিকদের আরও ৬টিসহ মোট ৩২টি আসনে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ এসব আসনে নৌকার প্রার্থী নেই। এর বাইরে মনোনয়নবঞ্চিত অনেক আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কোনো কোনো আসনে নৌকার প্রার্থীর চেয়েও এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অধিকতর শক্তিশালী। যে কারণে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলে শরিকরা যে সবগুলো আসনে জয়ী হবে, এমনটি নাও হতে পারে। অর্থাৎ কোথাও কোথাও জাতীয় পার্টির প্রার্থীও হেরে যেতে পারেন। তবে আওয়ামী লীগ যে দুইশর কম আসন পাবে না, সে বিষয়ে সম্ভবত কারও দ্বিমত বা সংশয় নেই। 

বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে কোনো বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন না। এরপর ষষ্ঠ সংসদও ছিল বিরোধী দলমুক্ত। দশম সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে ছিল বলে তাদেরকে ‘সরকারি বিরোধী দল’, ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। একাদশ সংসদেও জাতীয় পার্টি কার্যত সরকারের অংশ হিসেবেই কাজ করেছে। অতএব দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দল কারা হবে এবং তাদের ভূমিকা কী হবে, সেটি নিয়ে এবার আলোচনা হচ্ছে।

বাস্তবতা হলো, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সংখ্যাটা যদি এককভাবে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত আসনের চেয়ে বেশি হয় তাহলে স্বতন্ত্র এমপিরা মিলে বিরোধী দল গঠন করলে সেটি জাতীয় পার্টির চেয়েও ‍দুর্বল হবে। কেননা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ নেতা। অতএব বিরোধী দলে থাকলেও তারা কার্যত আওয়ামী লীগেরই লোক। অতএব বিরোধী দল হিসেবে তারা সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া কিংবা কার্যকর বিরোধী দল বলতে যা বোঝায়, সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন না। আবার জাতীয় পার্টির বাইরে জোটের অন্যান্য দল যেমন জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জোটের বাইরে থাকা অন্যান্য দল মিলেও গোটা তিরিশেক আসন পেলে, তারাও সম্মিলিত বিরোধী দল হতে পারে। কিন্তু তারও সম্ভাবনা কম। তার মানে ঘুরেফিরে জাতীয় পার্টিই যে এবারও বিরোধী দলের গ্যালারিতে বসবে, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। এর অন্যথা হলে সেটি হবে ‘দুর্ঘটনা’। প্রসঙ্গত ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী দল গঠনের উদাহরণ আছে।

বিরোধী দল নিয়ে কেন এই জটিলতা? বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতীয় সংসদের কার্যক্রম পরিচালিত হয় যে বিধির দ্বারা, তার কোথাও বিরোধী দল সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট বিধান নেই। অর্থাৎ তিনশ আসনের মধ্যে ন্যূনতম কতগুলো আসন পেলে তাকে বিরোধী দল বলা যাবে কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, তার যোগ্যতা কী হবে। যে কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ গঠনের সময়ও ‘বিরোধী দল’ ইস্যুতে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। তবে দীর্ঘদিনের রেওয়াজ এটি যে, অন্তত এক-দশমাংশ অর্থাৎ ৩০টি আসন না পেলে তাকে বিরোধী দল বলা যায় না।

প্রশ্ন হলো বিরোধী দল কী কাজে লাগে বা বিরোধী দল না থাকলে কী হয় অথবা নামসর্বস্ব থাকলেই বা দেশ ও জাতির কী লাভ-ক্ষতি?

সরকারে এবং সংসদে ভারসাম্য রক্ষা বা চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল থাকতে হয়। একটি দেশের গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী হবে তা নির্ভর করে সে দেশের বিরোধী দল কতটা শক্তিশালী তার ওপর। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারে, জনবিরোধী আইন করতে পারে, নাগরিকদের অসুবিধা বিবেচনায় না নিয়ে অতিরিক্ত কর আরোপের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। গত তিনটি সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সংসদে একতরফাভাবে অনেক আইন পাস হয়েছে, এমনকি ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীও হয়ে গেল কার্যকর কোনো বিতর্ক ছাড়া।

বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্য ছিলেন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং সে কারণে ওই তিনটি সংসদ তুলনামূলকভাবে প্রাণবন্ত ছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি কার্যকর ও শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনের জন্য অন্তত একশ আসন থাকা উচিত বলে মনে করা হয়। কেননা তাতে সংসদ প্রাণবন্ত হয়। আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি সদস্যের কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়। সংসদের বিরোধী দল শক্তিশালী না হলে তিন-চার মিনিটেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস হয়ে যেতে পারে, যার অনেক উদাহরণ গত তিনটি সংসদে আছে।

সরকারি দল যে বিল আনে, সাধারণত সেগুলো সংসদে উপস্থিত সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠভোটেই পাস হয়ে যায়। শুধু সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশের ভোট লাগে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠভোটে পাস হয়ে গেলেও দেশের মানুষ সংশ্লিষ্ট বিলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বা ইনটেনশন এবং এর দূরবর্তী নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে নির্মোহ ও যুক্তিপূর্ণ আলোচনা শুনতে চায়। সংসদে যদি শক্তিশালী বিরোধী দলই না থাকে; বিরোধী দল যদি গৃহপালিত কিংবা সরকারি বিরোধী দলে রূপান্তর হয়, তাহলে সেই সংসদে আইন প্রণয়ন কিংবা অন্য যে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা ও কর্মকা- একতরফা হতে বাধ্য।

বিরোধী দলের একটি প্রধান দায়িত্ব হলো সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। কিন্তু গত তিনটি সংসদে কী হয়েছে, তা সবার জানা। বলা হয়, তাৎক্ষণিকভাবে বিরোধী দল সরকারের বিকল্প এবং গণঅসন্তোষের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। এর কার্যক্রম অনেকাংশে সরকারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না। বস্তুত বিরোধী দলের সমালোচনার তীব্রতা ক্ষমতাসীন দলকে সংযত ও সতর্কভাবে চলতে বাধ্য করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বৈরাচারী মনোভাবকে প্রতিহত করে। 

কিন্তু অনেক সময়ই এরকম প্রশ্ন শোনা যায় যে, বাংলাদেশে কার্যকর বিরোধী দল কবে ছিল? কেননা আমাদের দেশে রাজনীতি ও সংসদে বিরোধিতার চর্চা রাজপথকেন্দ্রিক। সংসদে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা, বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরা, জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিতর্ক করা, এসবের চেয়ে বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথ গরম রাখতেই বেশি ব্যস্ত থাকে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছিল যে, তারা প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে চায়। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে চায় এবং জনগণের ভোগান্তি হয় এমন কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি তারা দেবে না। তাত্ত্বিকভাবে জাতীয় পার্টির এই অবস্থান প্রশংসনীয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে মন্ত্রিসভায় থাকায় তাদের নৈতিক জোরও ছিল কম। যে কারণে তারা চাইলেই সরকারের বিরোধিতা করতে পারেনি।

গণতন্ত্রে কেন বিরোধী দল দরকার, এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যত দিন না আমরা অপর পক্ষের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতে এবং তা গ্রহণ করতে শিখব; সৎভাবে বিবেচনা করতে শিখব, তত দিন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। যে সংসদে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দিলে বিরোধীদলীয় নেতা বা নেত্রী অনুপস্থিত থাকেন এবং বিরোধীদলীয় নেতা বা নেত্রী তার বক্তব্য পেশ করলে প্রধানমন্ত্রী অন্তর্ধান করেন, সেখানে গণতন্ত্র আসবে না। সেখানে সংসদের ভেতর কোরামহীন ধু-ধু মরুভূমি হবে এবং সংসদের বাইরে লাগাতার ধর্মঘটীদের হাতে ভগ্ন যানবাহন এবং পেটের দায়ে যে রিকশাওয়ালা রাস্তায় বেরিয়েছিল, তার দগ্ধ কালো কঙ্কাল দেখা যাবে।’

বস্তুত একটি কার্যকর সংসদ মানেই সেখানে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকবে এবং প্রাণবন্ত বিতর্ক হবে। অনেক সময় সংখ্যায় বিরোধী দলের সদস্য বেশি হলেও তাদের অব্যাহত বয়কটে সংসদ প্রাণহীন হয়ে যায়। আবার সংখ্যায় কম হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিরোধী দলের সদস্যরা সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে সংসদকে প্রাণবন্ত করে রাখতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের সংসদে সত্যিকারের বিরোধিতার চর্চা দীর্ঘদিন ছিল না। মাঝখানে কয়েক বছর থাকলেও সেটি আবার হাওয়া। অতএব আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে সরকার কারা গঠন করবে সেটি স্পষ্টত বোঝা গেলেও একাডেমিকভাবে বিরোধী দল বলতে যা বোঝায়, সেই জায়গায় যে এবারও একটি বিরাট শূন্যতা বিরাজ করবে, সে বিষয়েও সন্দেহ কম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //