ভোটের পরে চিনবেন তো!

ভোটে দাঁড়িয়েছেন প্রার্থী। জনগণের ভোট ছাড়া বিজয়ী হতে পারবেন না। ‘তাই ভোট চাই ভোটারের। দোয়া চাই সকলের’। নাওয়া খাওয়া ভুলে দিনরাত প্রার্থী ছুটে বেড়ান দ্বারে দ্বারে। সকাল বিকাল মধ্যরাত ভোটারের হাত ধরে, পায়ে সালাম করে, দোয়া নিতে প্রার্থীরা ছুটছেন। 

চমক দেখানোর জন্য কেউ কেউ আবার তাদের সাথে মাদুরে বসে ভাতও খান। জনতা মমতায় গলে পড়ে। তাদের মন বড়ই নরম। আহা এমন মাটির মানুষই তো চাই, হোক জনপ্রতিনিধি। মাথায় হাত দিয়ে দোয়া দেন বাড়ির বর্ষীয়ান মানুষটি। 

প্রার্থী আবার ছোটে। পরিবার পরিজন নয়, ভোটারই এখন সবচেয়ে আপন তার। মধ্যরাত, ২০ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টা তারা পড়ে থাকেন গ্রামের বিভিন্ন ভোটারের বাড়িতে। ভোটারের ভোটেই যে তার ক্ষমতায়ন। ভোটার যা বলে তাতেই মাথা ঝাঁকিয়ে হাসিমুখে সায় দেন। প্রতিশ্রুতির তুবড়ি ছোটে মুখে। রোদে পুড়ে চেহারা কালো করে ছোটেন বাংলার ঘরে ঘরে। খাওয়া নেই দাওয়া নেই শুধু ছুটে চলা। চায়ের দোকানে, পথে ঘাটে। 

ভোট শেষ, প্রার্থী বিজয়ী। ফুলের মালা গলায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সাথে মিশে গেছেন স্তাবক, সমর্থকরা। বিজয় মিছিলে কিন্তু নেই সেই সাধারণ জনতা। স্তাবকের ভিড়ে জায়গাই পান না তারা। 

জনতা আস্তে দূরে সরে যায়। দাপট তখন জনপ্রতিনিধির কাছের মানুষের, স্তাবকের। 

একবার এক জনপ্রতিনিধির অফিসে গিয়েছিলাম। জনপ্রতিনিধি বিশাল নরম গদিওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে খটখটে চেয়ারে বসে আছেন রুগ্ন শুকনো মলিন মুখের কিছু সাধারণ মানুষ। তারা আমজনতা। পায়ে তাদের দুই ফিতার স্যান্ডেল। কারও কারও পায়ে মাটি। এরা কেউ কেউ ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা বসে থাকার পর অবশেষে জনপ্রতিনিধির দর্শন পেয়েছেন। 

কুণ্ঠিত মুখের মানুষগুলো এলাকার জন্য কিছু চাইছেন। মিনমিন স্বরে সাহায্যের প্রত্যাশী তারা। খেয়াল করলাম জনপ্রতিনিধি তাদের কথা কিছু শুনলেন, কিছু শুনলেন না। একটু পর পর ফোনে হেসে হেসে কার সাথে যেন কথা বলছেন। এতগুলো মানুষ যে তার রুমে বসে আছেন অনেকটা সময় ধরে, এলাকার নানা সমস্যা  নিয়ে- এগুলো নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। 

মানুষগুলোকে সেদিন বড় অসহায় লেগেছিল। মনে হয়েছিল দামি কার্পেট করা রুমে মানুষগুলো জনপ্রতিনিধির কাছে বড় বেমানান। বড় সস্তা। লজ্জা লাগছিল নিজের কাছে।

সেদিনের সেই বর্ষীয়ান মানুষটিও দেখা করতে যান জনপ্রতিনিধির বাড়ি। তার এলাকার রাস্তা এবড়ো-থেবড়ো, আঠালো মাটির। হাঁটতে পারে না কেউ। হাটে যেতে কষ্ট হয় পণ্য নিয়ে। বড় মুখ করে এসেছেন তিনি। ৫ ঘণ্টা ধরে বসে আছেন। জনপ্রতিনিধির সময় নেই তার সাথে কথা বলবার। এত ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কাজ করার সময় আছে নাকি তার! 

কত দায়িত্ব এখন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বড় বড় বিষয় নিয়ে তাকে ভাবতে হয়। বড় বড় মানুষের সাথে ওঠাবসা। সময় কোথায় নষ্ট করবার? বড় দুঃখ পেয়ে বর্ষীয়ান মানুষটি চলে যান। 

পাঠক, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোট নাগরিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। ভোটের মাধ্যমেই নাগরিকরা তার এলাকায় যোগ্যতম প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন। জনগণ যদি নির্বাচনের প্রতি অনাগ্রহী হয়, উদাসীন হয়, নিরুৎসাহিত থাকেন, তা হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীকে বাছাই করে নেওয়া সম্ভব না। 

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫২ বছরের বেশি। স্বাধীনতার এত বছর পরও জনগণ যদি তাদের অধিকার, সম্মান না পায়, সেটা দেশেরই ক্ষতি। সুতরাং নিজেদের ভোটের বহুবিধ মূল্য জনগণকে অবশ্যই বুঝে নিতে হবে।

সামনে নির্বাচন, চলছে নানা হিসেব-নিকেশ। চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রার্থীরা যেতে শুরু করেছেন ভোটারের বাড়ি। নানা প্রতিশ্রুতির বাণী শোনাচ্ছেন। আকুলভাবে ভোট চাইছেন, নইলে নির্বাচিত হতে পারবেন না। ভোটাররাই যে তার ভাগ্য নির্ধারক। 

ভোটাররা রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক। প্রজাতন্ত্রের মালিক। তাই নাগরিক হিসেবে এবার তার অধিকার বুঝে নেওয়ার পালা। 

ভোট এলেই ভোটারদের দাম বাড়বে। আর ভোট শেষে তাদের কোনো দাম থাকবে না; এবার এর অবসান হওয়া দরকার। তার ভোটে নির্বাচিত হয়ে উঁচু পদে বসে থাকা মানুষ ভোটারদের তুচ্ছ মনে করবে তা যেন আর না হয়। জনপ্রতিনিধিদের বুঝিয়ে দিতে হবে জনগণের সেবার জন্যই তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তার সেবার জন্য জনগণ নয়। 

এলাকার উন্নয়নের জন্য যে বরাদ্দ আসে তার হিসেব নিন। কতটুকু কাজ হয়েছে, কী কাজ হচ্ছে, এগুলো জানা আপনার নাগরিক অধিকার। জনগণের টাকা দিয়ে দেশের উন্নয়ন হয়। তাই জনপ্রতিনিধি উন্নয়নের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার সবগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা জানতে চাওয়া দরকার।

এখনই প্রশ্ন করুন প্রার্থীকে, ভোটের পরে চিনবেন তো! জিতে গেলে যোগ্য সম্মান দিবেন তো? 

লেখক: সাংবাদিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //