নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের মচ্ছব

শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসন এবং কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীর (তারাও আওয়ামী লীগের নেতা) বাইরে এবার দুই শতাধিক আসনে নৌকার বিজয় নিশ্চিত। অতএব নৌকার প্রার্থীর ভোট না চাইলেও চলে, নির্বাচনী প্রচার কাজে কোটি কোটি টাকা খরচ না করলেও হয়। কিন্তু তার পরও হচ্ছে। প্রার্থীদের পক্ষে নানাবিধ শোডাউন যেমন হচ্ছে, তেমনি প্রতীক বরাদ্দের আগে থেকেই চলছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের মচ্ছব। শুধু তাই নয়, মাদারীপুরে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তি একজন বৃদ্ধ মানুষ। প্রশ্ন হলো, এই নির্বাচনেও খুনোখুনি কেন?

যে নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সেখানেও কেন আচরণবিধি লঙ্ঘনের মচ্ছব?

এবার নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের আগে থেকেই যাদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে, তাদের অধিকাংশই শাসক দলের প্রার্থী। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারসহ একাধিক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও পৌর মেয়রকে শোকজ করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। 

আওয়ামী লীগ যে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। জাতীয় পার্টি এবং শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া ৩২টি আসন এবং সর্বোচ্চ জনা তিরিশেক স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পেলেও আওয়ামী লীগ অন্তত ২৪০টি আসন পাবে বলে মনে হয়। ভোট যত অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হোক না কেন, তারপরও এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুইশর কম আসন পাওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হলো এমন নিশ্চয়তার পরও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে। তারা কি মনে করছেন বা ভয় পাচ্ছেন যে, বিএনপি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলেও তাদের কর্মী সমর্থকরা নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র অথবা অন্য দলের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে ভোটের ফলাফল উল্টে দেবেন? 

কয়েকটি কারণ থাকতে পারে
১. ভোটে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও নির্বাচনী প্রচারের একটি বিরাট অর্থনীতি আছে। প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষে যারা মিছিল করেন, সমাবেশে উপস্থিত হন, প্রার্থী ও প্রার্থীর নির্বাচন সমন্বয়কদের সঙ্গে চলাফেরা করেন, তাদেরকে পারিশ্রমিক দিতে হয়। ভোটের মৌসুমে তাদের কিছু উপার্জন হয়। ভোটের এই মৌসুমে বিভিন্ন জিনিসপত্রের বিক্রিও বেড়ে যায়। নির্বাচনী এলাকায় ছোট ছোট অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ডেকোরেটরের ব্যবসা চাঙ্গা হয়। বিশেষ করে চা সিগারেটের বিক্রি বাড়ে। সব মিলিয়ে বাজারে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এগুলো হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারের অর্থনীতি। 

২. প্রধানত মানুষকে জানানো যে, ‘আমি ছিলাম-আছি-থাকব এবং আমার কোনো বিকল্প নেই।’ অর্থাৎ আমি যে গত পাঁচ বছর ধরে ছিলাম, এত এত কাজ করেছি, হে ভোটারবৃন্দ, এলাকাবাসী- ভোটের মাঠে আমার কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকলেও ভোটকেন্দ্রে এসে আমার মার্কায় সিল দিয়ে আপনার অবস্থান স্পষ্ট করুন। কারণ ভোট একতরফা হলে, অর্থাৎ একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী না থাকলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহী হয় না। কেননা তারা ভাবে উনি তো এমনিতেই জিতবেন; খামাখা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সময় নষ্ট করার দরকার কী? যে কারণে বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে ৮-১০ শতাংশ ভোট পেয়েও অনেকে এমপি ও মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, যা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। ফলে ভোটে শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকলেও নির্বাচনী এলাকায় মিছিল মিটিং আর সমাবেশের মধ্য দিয়ে প্রার্থীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহ জোগান। এমনকি অনেক জায়গায় ভোটারদেরকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া এবং বাড়িতে দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও থাকে। অর্থাৎ ন্যূনতম সংখ্যায় ভোট পড়েছে, এটি যাতে নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু এবারের নির্বাচনটি যেহেতু সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষমতাসীন দলও বিতর্কমুক্ত রাখতে চায়, সে কারণে সবারই লক্ষ্য নির্বাচনে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করা, যাতে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহী হয়। সে কারণেই এত প্রচার, ডামাডোল। দিনভর মাইকে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর প্রশংসামূলক গান ও স্লোগানে কান ঝালাপালা। যাতে লোকেরা বোঝে যে দেশে ভোট হচ্ছে। 

৩. প্রার্থীরা নিজেদের অস্তিত্ব ও ক্ষমতার জানান দিতে চান। যে ক্ষমতাটি তিনি বিগত পাঁচ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে রেখেছেন, তার পক্ষে কত লোক আছে, সেসব নির্বাচনী এলাকার মানুষদের দেখাতে চান। ফলে খুব সামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো লোক এসেও যদি অন্তরায় সৃষ্টির চেষ্টা করে, সেটি ওই ক্ষমতাবানের পছন্দ হয় না। কারণ তিনি কোনো ধরনের প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চান না। চান না বলেই কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে দিতে রাজি নন। ফলে ছোট প্রতিপক্ষের কর্মকা-ও তার কাছে বড় হয়ে ওঠে এবং নিজের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটান। 

৪. অনেক সময় অতি উৎসাহ এখানে কাজ করে। প্রার্থীর পক্ষে সব সময় মাঠের খবর রাখা বা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কিন্তু তার দলের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা ভোটের মৌসুমে নিজের ক্ষমতা দেখাতে না পারলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত মনে করেন। অর্থাৎ তিনি যে অমুক ভাই বা আপার ঘনিষ্ঠ, সেটি লোকেরা কীভাবে বুঝবে? এজন্য তাকে এমন কিছু করতে হয় যেখানে ক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপার আছে। তিনি যে এতদিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা এমপি সাহেবের দাপট দেখিয়ে নানাবিধ ঠিকাদারি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন; কখনো পয়সা কিংবা বিনা পয়সায় মানুষের নানা সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন অথবা নেতার কাছে নিয়ে গেছেন, সেই দাপটটি যাতে আরও পাঁচ বছর অব্যাহত থাকে, সেজন্য ভোটের মাঠে তাকে কিছু করে দেখাতে হয়। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সেই ‘করে দেখানোটা’ সহজ হয়।

৫. নির্বাচন কমিশন বা জনগণকে পাত্তা না দেওয়াও এখানে একটি বড় কারণ বলে মনে হয়। নির্বাচনের আচরণবিধি অনুযায়ী, নির্বাচনের প্রচার শুরুর দিন না আসা পর্যন্ত পোস্টার, ব্যানার লাগানো বা দল বেঁধে মিছিল করা যাবে না। কোনো মিছিল বা শো-ডাউন করে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে না। শোভাযাত্রাও করা যাবে না। কিন্তু এর সবই হয়েছে। কারণ ক্ষমতার দাপট। প্রার্থীরা হয়তো ভেবেছেন যে তাদের বিজয় যেহেতু সময়ের ব্যাপারমাত্র, অতএব নির্বাচন কমিশন হোক আর যে-ই হোক, ‘কাউকে গোনার টাইম নাই’। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে শাস্তি হিসেবে প্রার্থিতাও বাতিল হতে পারে। কিন্তু শোকজ করা বা সতর্ক করা এবং সর্বোচ্চ জরিমানা করার চেয়ে বড় কোনো শাস্তি নির্বাচন কমিশন দেয় না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে তিনজনের প্রার্থিতা বাতিল করা হলেও তারা আদালত থেকে প্রার্থিতা ফিরে পান। অতএব যারা ক্ষমতাবান, তারা জেনেশুনেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন। কারণ এর মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষমতার প্রদর্শন সহজ। সংবাদ শিরোনামও হওয়া যায় দ্রুত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //