টাকার মান নামতে নামতে কোথায় যাবে

সম্প্রতি ভারতে গিয়ে বাংলাদেশি একশ টাকার বিপরীতে ভারতীয় রুপি পেয়েছি ৬৯ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশি ৫০ হাজার টাকা ভাঙালে ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, কলকাতা শহরে গিয়ে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি যে নিউমার্কেট ও মারকুইজ স্ট্রিট এলাকায় থাকেন, সেখানে একাধিক মানি এক্সচেঞ্জের দোকানে গিয়ে বাংলাদেশি টাকা দিয়ে ভারতীয় রুপি পাওয়া যায়নি। কারণ তারা এখন বাংলাদেশি মুদ্রা নিতে আগ্রহবোধ করেন না। 

এখান থেকে একটু দূরে গড়িয়াহাট এলাকায় গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়। সেখানে একজন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী টাকা নিতে অনীহা প্রকাশ করলে এর কারণ জিজ্ঞেস করি। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, তার কাছে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি টাকা পড়ে আছে। ফলে এখন আর টাকা নিতে চান না। অথচ করোনার ধাক্কা শুরুর আগের মাসেও অর্থাৎ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও চুয়াডাঙ্গার ওপারে গেদে বর্ডারে বাংলাদেশি একশ টাকার বিপরীতে ভারতীয় ৮৬ রুপি পেয়েছিলাম। 

প্রশ্ন হলো, আড়াই-তিন বছরের মধ্যে কী এমন ঘটনা ঘটল যে, ভারতে বাংলাদেশি মুদ্রার মান শতকরা ১৭ টাকা কমে গেল? ভারতের অর্থনীতি কি বাংলাদেশের চেয়ে এত বেশি ভালো কিংবা ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি কি এতই দুর্বল যে, পাশাপাশি দুটি দেশের মুদ্রার মানে এত তফাত হবে? বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভারতের কলকাতাসহ নানা এলাকায় যান ভ্রমণ, ব্যবসা ও চিকিৎসার কাজে। অফিসিয়াল কাজ এবং শিক্ষার জন্যও অনেকে যান। বলাই হয়, ভারতের কলকাতা, চেন্নাই ও ভেলরের মেডিক্যাল এবং দার্জিলিংসহ বিভিন্ন এলাকার পর্যটন কেন্দ্রগুলোর আয়ের বিরাট উৎস এই বাংলাদেশিরা। অথচ সেখানে গিয়ে তারা যখন বাংলাদেশি টাকার বিপরীতে ভারতীয় রুপি বদল করেন, সেখানে তাদের অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে যারা চিকিৎসার জন্য যান, যাদের ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে হয়, তাদের জন্য বিপত্তিটা অনেক বেশি। কারও যদি চিকিৎসায় ভারতীয় এক লাখ রুপি খরচ হয়, সেটি বাংলাদেশি টাকায় দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ ৩২ হাজার টাকা। বাংলাদেশ ও ভারতের মুদ্রায় এত পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। 

এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ডলারের দাম যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী, তার সঙ্গে ভারতীয় রুপিরও সম্পর্ক আছে। এখন ডলার সংকটের কথা গোপন বিষয় নয়। খোলা বাজারে ডলারের দাম এখন ১২৫ টাকার বেশি। অর্থাৎ এক ডলার কিনতে হলে এখন বাংলাদেশি মুদ্রায় দিতে হবে ১২৫ টাকা বা তারও বেশি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ডলারের দাম বাড়ছে। শুধু ডলার নয়, অন্যান্য বিদেশি মুদ্রার দামও রাতারাতি ৪-৫ টাকা বেড়ে গেছে বলে সম্প্র্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। বৈধ পথে অর্থ পাঠানোকে উৎসাহিত করতে কিছু কিছু ব্যাংক প্রতি ডলারে ১২৪ টাকা দিচ্ছে, এমন খবর শোনা গেলেও খোলা বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ হয়নি।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখন চাইলেই সহজ পথে ডলার কেনা যাচ্ছে না। এই বাস্তবতাটি ইমিগ্রেশনের অফিসাররাও জানেন। জানেন বলে তারা ইমিগ্রেশনে কোনো বাংলাদেশিকে এখন আর প্রশ্ন করেন না ডলার এনডোর্স করা আছে কি না বা কত ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশি টাকা নিয়ে যাওয়া অবৈধ জানার পরও এটি নিয়ে সাধারণত বিমানবন্দরে প্রশ্নও করা হয় না। ট্রেন বা বাসের যাত্রীদের হয়তো প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু সেখানেও আগের মতো কড়াকড়ি নেই বলে মনে হয়। কেননা তারাও ডলার সংকটের খবর জানেন। যে সংকটের কারণে একটি অবৈধ বিষয় অনেকটা বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে। এটি আখেরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও সুখকর নয়। 

টাকার বিপরীতে রুপির দাম বেড়ে যাওয়া তথা রুপির বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় সংকটে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। কেননা তারা এক লাখ রুপিতে যে পণ্য কিনছেন, বাংলাদেশি টাকায় সেটির দাম পড়ছে প্রায় ৩২ হাজার টাকা বেশি। সঙ্গত কারণে দেশে আনার পর ওই পণ্যের বিক্রয়মূল্য বেড়ে যাচ্ছে অনেক, যে বাড়তি টাকাটা যাচ্ছে আসলে ভোক্তার পকেট থেকে। 

আগে ভারত থেকে পণ্য আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক ডলার সংকট এবং এলসি খোলার জটিলতার কারণে ভারতের সঙ্গে এখন ব্যবসায়ীরা রুপিতে লেনদেনের কিছুটা সুবিধা পাচ্ছেন। গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে রুপির ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক শুরুতে সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডকে এই কার্যক্রমে যুক্ত করে। চুক্তি অনুযায়ী টাকা ও রুপি দুটি মুদ্রা ব্যবহার করে লেনদেনের ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হলেও আপাতত শুধু রুপিতেই লেনদেন হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে রুপিতে লেনদেনের জন্য বাংলাদেশের আরও দুটি বেসরকারি ব্যাংককে অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন অনুমতি পাওয়া ব্যাংক দুইটি হচ্ছে-ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। (বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারত থেকে বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। বিপরীতে দুই বিলিয়ন বা দুইশ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। 

মুশকিল হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা শুধু রপ্তানির ক্ষেত্রে রুপিতে লেনদেন করতে পারছেন। কিন্তু আমদানি করতে হবে ডলারেই। তাছাড়া এই সুবিধা নিচ্ছে খুবই সামান্য সংখ্যক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ফলে আমদানি-রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই রুপির ব্যবহার বাড়ানো গেলে এবং ব্যাপক হারে ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ নিতে পারলে কিছুটা সাশ্রয় হয়তো হবে। কিন্তু টাকার বিপরীতে রুপির দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আখেরে কতটুকু লাভ হবে, সেটি বিরাট প্রশ্ন। বরং ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে এবং এলসি খোলা নিয়ে যে ধরনের সংকটের খবর গণমাধ্যমে আসছে, তাতে দেশের আমদানি-রপ্তানিনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, সেটি ওপেন সিক্রেট। এই পরিস্থিতি কবে সহনীয় হবে বা এই বিপদ কবে কাটবে, সেটিও নিশ্চিত করে বলা কঠিন। সামনের দিনগুলো আরও খারাপ নাকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের অর্থনীতি আরও বাজে পরিস্থিতির ভেতরে ঢুকে যাবে, সেটিই এখন বড় চিন্তার বিষয়। 

বাংলাদেশ সরকার চাইলেই রুপির বিপরীতে টাকার মান বাড়াতে পারবে না। এটি বাজার অর্থনীতির নানা বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব সূত্র না বুঝলেও বা বুঝতে না চাইলেও তারা সবকিছু নিজের জীবন ও অর্থের মাপকাঠিতে মাপতে চায়। ফলে সে যখন ভারতে চিকিৎসা, ভ্রমণ, ব্যবসা, শিক্ষা কিংবা অন্য যে কোনো কাজে গিয়ে এক হাজার টাকার বিপরীতে ৬৯০ টাকা পায়, তখন তার মনে প্রশ্ন জাগে, পাশাপাশি এবং বন্ধুপ্রতিম দুটি রাষ্ট্রের মুদ্রার মাঝখানে কেন ৩০-৩১ টাকার পার্থক্য থাকবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, রুপির বিপরীতে টাকার মান কমতে কমতে ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে? এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তখন কি বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভ্রমণ, চিকিৎসা ও অন্যান্য কাজে মানুষের যাতায়াত কমে যাবে? যদি তা-ই হয় তাহলে সেটি কি ভারতের পর্যটন ও মেডিক্যাল ব্যবসায় বড় ধরনের ধাক্কা দেবে না?


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //