ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের গতি কোনদিকে

গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার শুরু থেকে সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, বর্ণ ও জাতি-পরিচয়ের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মিছিল ও সমাবেশ করেছে। কিন্তু ভারতে তা নির্বিঘ্নে সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে ‘ভারতীয় আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল’-এর গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিভাগের সহযোগী পরিচালক সাফা আহমেদ ‘জ্যাকোবিন’ সাময়িকীতে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন (Why Far-Right Hindus Love Demonizing Palestinians, ১৫ নভেম্বর ২০২৩)। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন ভারতীয় মুসলিমরা ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার, পুলিশের হাতে আটক ও ভারতবিদ্বেষী সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। 

উক্ত প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “প্রতিপক্ষকে দমন করতে হিন্দুত্ববাদও জায়নবাদের খেলার কৌশল আয়ত্ত করতে শুরু করেছে, তা হলো : গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রচারণা দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া, বুলডোজার দিয়ে মুসলমানদের বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং বর্ণবাদী ও জাতিবিদ্বেষী রাজনীতিকে যারাই রুখে দাঁড়ান তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া।” 

লন্ডনের প্লুটো প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত আজাদ এশার সাম্প্রতিক বই Hostile Homelands: The New Alliance Between India and Israel ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের এই দীর্ঘমেয়াদি মেরুকরণ বিষয়ে আলোকপাত করেছে। এশা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক Middle East Eye পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। তিনি বর্তমান আলোচ্য বইটি ছাড়াও The Moslems Are Coming I Zama's Bastard বইয়ের লেখক।

নিজভূমে পরবাসী বা Hostile Homelands বইটি ভারত ও ইসরায়েলের আদর্শিক নৈকট্য লাভের নাটকীয় ছবি তুলে ধরেছে, যা বর্তমান বিশ্বে যে কোনো দুটি দেশের ক্ষেত্রে বেশ লক্ষণীয় হতে পারে। এ দুটি দেশই আপন ভূরাজনৈতিক সীমানায় নিজেদের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। অথচ তারা দুইই আবার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বর্ণবাদী ও জাতিগত নিপীড়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আদর্শিকভাবে তাদের এ কাছাকাছি আসা বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্বে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।       

দুটি দেশেই সামরিক শক্তির দ্বারা পিষ্ট হচ্ছে নিজ ভূখণ্ডের মুসলিম জনগোষ্ঠী। সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে দুটি ভূখণ্ড কাশ্মীর ও প্যালেস্টাইন। বিরাট পৃথিবীর বুকে এ দুটি ছোট্ট ভূখণ্ড আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে ঔপনিবেশিক ভাগ্যের কারণে। এ দুটি ভূখণ্ডে দুটি পুরনো ধর্মবিশ্বাসের উগ্র বিকৃতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সফল প্রয়োগ চালাচ্ছে হিন্দুধর্মের নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ও ইহুদিধর্মের নামে উগ্র জায়নবাদীরা; যার শিকার এখানকার অধিবাসীরা।           

যদিও এ দুটি দেশ বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রার শুরুতে আদর্শিক দিক থেকে বিপরীত মেরুর ছিল, বর্তমানে তারা মোদি আর নেতানিয়াহুর মতোই ঘনিষ্ঠ। এশার কথা অনুযায়ী, এ দুই নেতা “একে অপরের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন মনের ঐক্য একটি সংস্কৃতি, একটি বর্ণ ও একটি জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে তোলার দৃঢ়তা। (প্রিয়া অরবিন্দন কর্তৃক বই-আলোচনা, Washington Report on Middle East Affairs, জুন/জুলাই ২০২৩)        

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে নৃতত্ত্ব ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যয়নরত অরবিন্দন লিখেছেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় ‘ভারত ঢুকিয়ে’ কাশ্মীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভারত বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছে। বিচার-বহির্ভূত হত্যা থেকে শুরু করে বাড়িঘর ধ্বংস ও ভারতীয় দখল পর্যন্ত সবই ক্রমান্বয়ে ইসরায়েলের প্যালেস্টাইন দখলের অনুরূপ চেহারা লাভ করছে। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের অনেকে নিজেরাই এ তুলনা করেছেন। ২০১৯-এর নভেম্বরে কাশ্মীরে দখল ও অবৈধ বসতি স্থাপন সম্পর্কে বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় কনসাল জেনারেল সন্দ্বীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘যদি ইসরায়েলের মানুষ এটা পারে, আমরাও পারব।’ চক্রবর্তীর মন্তব্যটিতে ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে গড়ে ওঠা আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।      

“প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা যখন বৈশ্বিক বাম শক্তির কেন্দ্রীয় বিষয়, কাশ্মীরের স্বাধীনতা চাপা পড়ে থাকে। এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘ধর্মীয় বিতর্কে’ পর্যবসিত হয়। Hostile Homelands: The New Alliance Between India and Israel বইয়ে লেখক আজাদ এশা ইসরায়েলি জায়নবাদের সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্ক চিহ্নিত করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ওপর আলো ফেলেছেন। এশা প্রকাশ করেছেন কীভাবে আধিপত্যকামী বর্ণবাদের ওপর ভারতীয় ও ইসরায়েলি জাতীয়তার প্রকল্প নির্মিত যা দখলের শিকার কাশ্মীরের ও প্যালেস্টাইনের জনগণের জন্য ভয়ংকর।”     

ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল যে ভারত তার জন্য এ অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। যে রাষ্ট্র ষোড়শ শতকে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে ধর্মবিশ্বাস, চিন্তা, জাতীয়তা ইত্যাদির বৈচিত্র্যকে উচ্চতম গর্বের সঙ্গে লালন করেছে যখন ইউরোপ ছিল অসহিষ্ণুতার অন্ধকারে নিমজ্জিত তার জন্য এ অবস্থা মর্মান্তিক। (অমর্ত্য সেন, The Argumentative Indian, ২০০৫, পেঙ্গুইন, ইউকে) Essentials of Hindutva বইয়ের লেখক বিনায়ক দামোদর সাভারকার হিন্দুত্ববাদী আদর্শের জনক। একই বছর জায়নবাদী জেভ জাবোতিনস্কি প্যালেস্টিনিয়ানদের ওপর বলপ্রয়োগের ওকালতি করে Iron Wall শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখেন। এশা দেখিয়েছেন ভারত ও ইসরায়েলের এখনকার মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তুলতে সাভারকারের বড় ভূমিকা রয়েছে। জ্যাকোবিনের প্রবন্ধে সাফা লিখেছেন, “উল্লেখযোগ্য হলো, বিনায়ক সাভারকার ও এমএস গোলওয়ালকারের মতো মতান্ধসহ হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠাতারা প্রকাশ্যে হলোকাস্টের সময় ইহুদি গণহত্যার ও নাৎসিবাদের প্রশংসা করেছে।” 

সাভারকার দ্বিজাতি তত্ত্বেরও আবিষ্কর্তা, যার পরিণতিতে ভারত দুটি সংঘর্ষমূলক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়। অমর্ত্য সেনের মতো সে এই মত চালু করে “জিন্নাহর এ প্রসঙ্গ তোলার পনেরো বছরেরও বেশি আগে। তৎকালীন হিন্দু রাজনীতির পক্ষে দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতার জন্য মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে যে নাথুরাম গডসে সে ছিল সাভারকারের শিষ্য।” (The Argumentative Indian) ভারতীয় রাজনীতির এই স্পষ্ট বিকাশের চিত্র উঠে এসেছে আজাদ এশার হোস্টাইল হোমল্যান্ডস বইটিতে। তিনি দেখিয়েছেন, ভারত কীভাবে হারাচ্ছে তার মুক্ত আলোচনাকেন্দ্রিক ভারতীয়তা যে ভারত একসময় বিশ্ব ইতিহাসে বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। 

লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //