নির্বাচনে কতটি আসন পাবে ‘কিংস পার্টি’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এতই বড় ও শক্তিশালী যে, প্রভাবমুক্ত স্বাভাবিক নির্বাচনে এককভাবে ভোট করলেই এই দুটি দল সরকার গঠনের মতো আসন পায়। কিন্তু তার পরও ভোট এলেই ছোট ছোট দলের কদর বাড়ে। তাদের নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়। বড় দলের সঙ্গে ছোট দলের তো বটেই, কখনো ছোট ছোট অনেক দল মিলেও নির্বাচনী জোট গঠন করে। কিন্তু ভোটের হিসাব-নিকাশে এসব জোটের কি কোনো তাৎপর্য আছে?

সম্প্রতি কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন জোট গঠন করে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, যার দলকে অনেকে ‘কিংস পার্টি’ বলে সম্বোধন করেন। এক-এগারোর সরকারের সময়ে গঠিত সৈয়দ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবিতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল। কিন্তু ভোটের আগ মুহূর্তে তারা বিএনপির বলয় থেকে বেরিয়ে এসে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিল এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন) নিয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে নতুন জোট গঠনের ঘোষণা দিল।

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আন্দোলন ছেড়ে ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাকে ‘মীরজাফর’ বলা হতে পারে, তা তিনি জানেন। ঝুঁকি মেনেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ তারা চান, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য’ হোক। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানামুখী সমালোচনার মুখে তিনি অবশ্য একটি ভিডিওবার্তায় বলেছেন, এখানেই সবকিছু শেষ নয়। আরও অনেক কিছুই হতে পারে।  

যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, যে তিনটি দল নিয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে জোট গঠন করা হলো, তাদের সম্মিলিত ভোটের সংখ্যা কত? এই তিনটি দলের প্রার্থীরা একক কিংবা জোটবদ্ধ হয়ে, অর্থাৎ ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে প্রার্থী দিলেও দেশের কোনো আসনে তাদের প্রার্থীরা জয়ী হবেন? দেশের ভোটের রাজনীতিতে এসব দল ও জোটের কি আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে? 

প্রসঙ্গত ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘কিংস পার্টি’ শব্দযুগল বেশ আলোচিত হয়েছিল। অর্থেই বোঝা যাচ্ছে ‘কিংস পার্টি’ মানে রাজার দল। রাজা মানে ক্ষমতাসীনদের অনুগত দল, যারা ভোটে অংশ নিয়ে কতটি আসন পেল, তার চেয়ে বড় কথা তারা ভোটকে জায়েজ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সামরিক বাহিনী যেহেতু সরাসরি রাজনীতি করতে পারে না, সেজন্য অনেক সময় তাদের পৃষ্ঠাপোষকতায় এরকম কিংস পার্টি গড়ে তোলা হয়, যাদেরকে নিয়ে নানাবিধ উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা হয়।

সৈয়দ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ছাড়াও আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের পর জরুরি অবস্থার সময়ে যেসব দল গঠিত হয়, তার মধ্যে ছিল ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর নেতৃত্বে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী ফারুক আহম্মদের ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ইত্যাদি। যদিও কল্যাণ পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলো এখন আলোচনায় নেই। 

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে বিএনএম এবং তৃণমূল বিএনপি নামে যে দুটি দল সক্রিয় হয়েছে, তাদেরকেও অনেকে কিংস পার্টি বলছে। কেননা একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সরকারের পৃষ্ঠাপোষতায় এই দল দুটি গঠন করা হয়েছে বলে গুঞ্জন আছে। দুটি দলেই বিএনপির একাধিক সাবেক নেতা রয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের তরফেও অনেক দিন ধরে বলা হচ্ছে যে, আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নির্বাচনে না এলেও তাদের অনেক নেতা স্বতন্ত্র অথবা অন্য কোনো দল থেকে নির্বাচন করবেন। তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএমকে ইঙ্গিত করেই হয়তো আওয়ামী লীগ নেতারা এই ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। 

আসন্ন নির্বাচনে মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি না এলে যেহেতু এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠতে পারে এবং নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে অভিযোগ উঠতে পারে, সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে ক্ষমতাসীন দল হয়তো চাইছে বিএনপির একটি অংশকে বিকল্প উপায়ে ভোটে নিয়ে আসতে, যাতে এটি বলা যায় যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নির্বাচনে না এলেও তাদের অনেক নেতাই অংশ নিয়েছেন। 

প্রসঙ্গত তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার। শমসের মবিন চৌধুরী ক্যান্সারসহ স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে প্রায় আট বছর আগে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। আর তৈমুর আলম খন্দকার অনেক দিন ধরে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতেই কোণঠাসা। 

অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নামে দলেও আছেন বিএনপির সাবেক অন্তত চারজন সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বাকি তিনজন হলেন ঝিনাইদহ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল ওহাব, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান শামসুল আবেদিন এবং বরগুনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুর রহমান। 

বছর দুয়েক আগে বিএনপির দলত্যাগী এক নেতার হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করা বিএনএমকে গত আগস্টে নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে না থাকা দলটিকে নিবন্ধন দেওয়ায় কমিশনের ওই সিদ্ধান্তের তুমুল সমালোচনা হয়। বিএনএমকে ‘কিংস পার্টি’ আখ্যায়িত করেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা। 

বিএনপির পক্ষ থেকেও বেশ কিছুদিন ধরে অভিযোগ করা হচ্ছে, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার নিজেদের ছত্রছায়ায় ‘কিংস পার্টি’ গঠন করে বিরোধী দলগুলোতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে। আগেও নির্বাচনের সময় বিএনপি এ ধরনের অভিযোগ তুলেছিল।

প্রশ্ন হলো, এ ধরনের কিংস পার্টি গড়ে তোলা কিংবা ছোট দলগুলোর সঙ্গে বড় দলগুলোকে কেন জোট করতে হয় বা সমঝোতায় যেতে হয়? অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে প্রধান কারণ ছোট ছোট দলকে বড় দলগুলো কাছে রাখতে চায় যাতে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী বড় দলের সঙ্গে জোট করতে না পারে। এখানে ভোটের চেয়েও দল ভারী দেখানো এবং প্রতিপক্ষের ওপর নৈতিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করা একটি লক্ষ্য। আরেকটি লক্ষ্য থাকে ভোটে অনেক বেশি দলের অংশগ্রহণ দেখানো। অনেক সময় ছোট ছোট দল গঠন করে ওসব ছোট দলের নেতারা মন্ত্রিসভায়ও জায়গা করে নেন। অর্থাৎ এসব দল দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বিকাশে কোনো অবদান রাখতে না পারলেও নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারেন।

এবারও সমঝোতার ভিত্তিতে বেশ কিছু আসনে আওয়ামী লীগ হয়তো ছাড় দিতে পারে, যাতে এসব ‘কিংস পার্টি’ কিংবা অপেক্ষাকৃত ছোট দলের প্রার্থীরা জয়ী হন। যাতে আগের মতো দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হতে না পারেন। 

এবারের নির্বাচনের ওপর যেহেতু বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কড়া নজর রাখছে, সে কারণে আগের দুটি নির্বাচনের মতো যাতে এবারের নির্বাচন একতরফা না হয়; দৃশ্যত একটি অবাধ সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক ভোট হয়, ক্ষমতাসীন দল তথা নির্বাচন কমিশনের সেই চেষ্টা থাকবে। সেক্ষেত্রে বেশ কিছু আসন শরিক এবং কিংস পার্টি তথা ছোট ছোট দলকে ছেড়ে দিতে হবে। 

যেহেতু বিরোধী দল হওয়ার জন্য বেশ কিছু আসন দরকার, অতএব জাতীয় পার্টিকেও কিছু আসন ছেড়ে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি এককভাবে প্রধান বিরোধী দল নাকি জাতীয় পার্টির পাশাপাশি এসব ছোট ছোট দলও বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে, সেটি এখনো বলা মুশকিল। আবার বিএনপির যে অংশটিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে, তারা ভোটে জিতলে তাদেরকে মন্ত্রিসভায় যুক্ত করা হতে পারে, এমন গুঞ্জনও রয়েছে। 

তবে চ্যালেঞ্জ অন্যখানে। সেটি হলো, যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে আসছে না, অতএব আওয়ামী লীগ যে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, সেটি এখন মোটামুটি নিশ্চিত। অতএব যেসব আসনে জাতীয় পার্টি, শরিক দল, কিংস পার্টির প্রার্থীদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে, সেসব আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং মনোনয়নবঞ্চিত আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভূমিকা কী হবে? তারা কি ছাড় দিতে রাজি হবেন? যদি না হন তাহলে কি ভোট অবাধ সুষ্ঠু শন্তিপূর্ণ এবং প্রভাবমুক্ত হবে? অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ভোট হলে কি এসব ছোট ছোট দলের প্রার্থীরা জয়ী হয়ে আসতে পারবেন? ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, যুক্তফ্রন্ট, তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএমহ সরকারপন্থি অন্যান্য ছোট দলগুলোর ভাগে কী অপেক্ষা করছে, সে বিষয়ে এখনই কোনো উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন। 

তবে সৈয়দ ইবরাহিমের নেতৃত্বে তিনটি দল মিলে যুক্তফ্রন্ট নামে যে জোট গঠন করেছে, সেটি নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার না করলেও ভোটের আগে এসব ঘটনার সংবাদমূল্য আছে। বিশেষ করে ভোট ও নির্বাচনী রাজনীতি নিয়ে কী হচ্ছে; কার সঙ্গে কার যুক্ততা ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে; কে কার কাছে বন্ধু, বেইমান অথবা সুবিধাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন, সেসব বোঝার জন্য এই ঘটনাগুলোর কিছু গুরুত্ব আছে। ভোট ও নির্বাচনী রাজনীতির ইতিহাস লিখতেও এসব ঘটনা ছোট ছোট কেসস্টাডি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //