ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রহেলিকা

সতেরো শতকে ইউরোপের মাটি কাঁপিয়ে ঘটল রেনেসাঁস (নবজাগরণ)। ইউরোপীয় নবজাগরণ শুধু পশ্চিমা বিশ্বকেই আলোড়িত করল না; গোটা বিশ্বকেই কম-বেশি আলোড়িত করল। রেনেসাঁসের আগে মানুষ প্রকৃতির খেয়াল-খুশি এবং ধর্মতত্ত্বের ঈশ্বরের কৃপা ও অনুকম্পার হাতে বন্দিদশায় ছিল। রেনেসাঁস বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষকে সেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করল। ঘোষিত হলো মানুষের স্বাধীনতা। সকল মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির অঙ্গীকার ঘোষিত হলো। পৃথিবীতে যুদ্ধ নামক বিপর্যয় যাতে আর না ঘটে, এ ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্পের কথাও উচ্চারিত হলো। এখন থেকে পৃথিবীতে বিরাজ করবে অক্ষয় শান্তি, এই মর্ত হবে স্বর্গ। কত আশা, সাধ, স্বপ্ন তখন পশ্চিমের মানুষদের মনে। এদিকে সকল মানুষের স্বাধীনতার ঘোষণার পাশাপাশি গোটা ইউরোপে তখন ব্যক্তিস্বাধীনতারও জয়-জয়কার। আমাদের বর্তমান আলোচনার বিষয় হলো ব্যক্তিস্বাধীনতা। 

ব্যক্তিস্বাধীনতা নামের প্রবচনটি খুবই প্রহেলিকাময়। মানুষের স্বাধীনতার কথা যখন বলা হয় তখন সকল মানুষের কথাই বোঝায়। তাই সমাজের সকল মানুষের তথা সমষ্টির স্বাধীনতার অর্থ নিঃসন্দেহে ব্যক্তিরও স্বাধীনতা। তবে মানুষ যেহেতু সমাজবদ্ধ জীব, তাই ব্যক্তিস্বাধীনতার অর্থ সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রত্যেক ব্যক্তির আলাদা আলাদা স্বাধীনতা নয়। সমাজবদ্ধ মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা হলো, সকল মানুষের যৌথ স্বাধীনতা। সামাজিক উৎপাদনের কাজে মানুষের শ্রম যেমন যৌথ, তাই সমাজে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতা হলো যৌথ স্বাধীনতার অন্তর্গত। এককথায় সেটি হলো বহু মানুষের সম্মিলিত স্বাধীনতা এবং সেই সাথে ব্যক্তিরও স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সাযুজ্য থাকবে, ভারসাম্য থাকবে, কিন্তু বিশেষ কোনো স্বাতন্ত্র্য থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। সাধারণভাবে ব্যক্তিমানুষের স্বাতন্ত্র্য বা বিশেষত্ব প্রকাশ পায় তার কর্মে ও আচরণে। কর্মে কারও থাকে দক্ষতা ও নৈপুণ্য বেশি, কারও কম। কেউ থাকে হাসি-খুশি, কেউ গম্ভীর। এগুলো মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় এবং একই সাথে ব্যক্তিস্বাধীনতাও বটে। অবশ্য ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসর আরও বড় হতে পারে। সে যা-ই হোক, মূল কথা হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ব্যক্তিস্বাধীনতা ভোগ করতে পারে, তবে তা অন্যের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে।

ব্যক্তিস্বাধীনতা কোনো নিঃশর্ত বা বল্গাহীন নয়। একজনের স্বাধীনতা যদি সমষ্টির বা অন্যের স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত করে, আঘাত করে, তার নাম ব্যক্তিস্বাধীনতা হয়। সেটি ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতা, নৈরাজ্যবাদিতা। একজনের অবাধ, নিঃশর্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা কখনো কখনো বহু মানুষের পরাধীনতা ও দাসত্বের কারণ হতে পারে। রেনেসাঁসের মাধ্যমে গোটা পশ্চিমা বিশ্বে ব্যক্তিস্বাধীনতার যে জয়-জয়কার শুরু হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তিস্বাধীনতা সমাজে কীভাবে অধিকাংশ মানুষের পরাধীনতা ও দাসত্বের কারণ হয়ে উঠেছিল, সেই বিষয়ে এখন কথা বলব।

এ ক্ষেত্রে আবারও বলি, অন্যের স্বাধীনতাকে খর্ব করে বা ধ্বংস করে নিজের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের নাম ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়। এ ধরনের বোধের মধ্যে নিহিত থাকে ব্যক্তির বিশেষত্ব, স্বাতন্ত্র্য বা শ্রেষ্ঠত্বের বোধ। নিহিত থাকে অহংবোধ ও ক্ষমতার লিপ্সা। থাকে, অন্যদের থেকে আমি স্বতন্ত্র, আলাদা, শ্রেষ্ঠ- এই বোধ। এই ধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তুলনা করা যায় কোনো পরিবার বা গোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তি অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীর ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে। পরিবার বা গোষ্ঠীপ্রধানের নিজের স্বাতন্ত্র্যবোধ, অন্যদের থেকে আলাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের বোধ, প্রভুত্বের বোধ পরিবার বা গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহের কারণ ঘটে, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং তার পরিণতিতে পরিবার বা গোষ্ঠী ভেঙে যায়। ব্যক্তিস্বাধীনতার অপব্যবহারই এর মূল কারণ। একইভাবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার কানাগলিতে জন্ম নেওয়া স্বাতন্ত্র্যবোধ, দলের অন্যদের থেকে আলাদা বা শ্রেষ্ঠত্ববোধ, অহংবোধ ইত্যাদি কারণে দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব-কলহ বা ষড়যন্ত্র দানা বাঁধে, দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং দলে ভাঙন ধরে। রাজনৈতিক দল ভাঙাভাঙির প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে দলের নেতার স্বাতন্ত্র্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও অহংবোধ। এখানেও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রহেলিকা। বৃহত্তর পরিসরে এ ধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তুলনা করা যায় হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাঙ্কো, বুশ, নেতানিয়াহু, পুতিনের ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে ব্যক্তি ইগো, অহংবোধ, অপার ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বের বোধের সঙ্গে। এদের তথাকথিত ব্যক্তিস্বাধীনতার মাশুল দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ, নর-নারী, শিশুকে- ব্যক্তিস্বাধীনতা নামের ক্ষমতার বোমা, বুলেট ও ট্যাঙ্কের নিচে জীবন দিয়ে।

দুই
ইউরোপে রেনেসাঁস ও শিল্পবিপ্লবের পর সমাজের বণিক পুঁজির মালিকদের উদ্যোগে গড়ে উঠতে লাগল ছোট-বড়-মাঝারি আধুনিক শিল্পকারখানা। এসব শিল্পকারখানায় উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত হলো সেই সব লোক, যারা ইতিমধ্যে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বেকারবাহিনীতে পরিণত হয়। এরাই ছিল, মাত্র কিছুদিন আগে ইউরোপীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শোষিত-নিপীড়িত এবং বিক্ষুব্ধ কৃষকবাহিনী।

এরাই যাজকতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রবিরোধী বিপ্লবে সমাজের মধ্যবিত্ত বণিকশ্রেণির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবনপণ লড়াই করে বিপ্লবে বিজয় অর্জন করেছিল। ইউরোপে সামন্তবাদবিরোধী সেই বিপ্লবটা ছিল মূলত কৃষকদের বিপ্লব। কৃষকের মুক্তির বিপ্লব। রেনেসাঁস, কৃষকবিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবের ঘোষণা অনুযায়ী কৃষক-বণিকসহ সকল স্তরের মানুষ হয়ে উঠেছিল সমান স্বাধীন। সেটি ছিল সমষ্টির স্বাধীনতা। বিপ্লব-পরবর্তীকালে সেই বিপ্লবী কৃষকদের ভূমিচ্যুত করে তাদেরকে শিল্পোৎপাদনের কাজে নিয়োজিত করার পর, রেনেসাঁস ও বিপ্লবের অঙ্গীকার অনুযায়ী বণিক-শিল্পোদ্যোক্তাদের দায়িত্ব ছিল, তাদের দুদিন আগের সহ-কমরেড শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা এবং সেই সঙ্গে কারখানার ওপর শ্রমিকদেরও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। 

কিন্তু বাস্তবে ঘটল ঠিক তার উল্টো। রেনেসাঁস ও বিপ্লবের অঙ্গীকারকে ভূলুন্ঠিত করে শিল্পোদ্যোক্তারা কারখানার শ্রমিকদের ওপর শুরু করল নির্মম শোষণ ও নিপীড়ন। এর ফলে ইউরোপীয় সমাজ নতুন করে প্রধানত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে গেল- একদিকে অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা ভোগকারী শিল্পপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণি, অন্যদিকে পরাধীন শ্রমদাস সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণি। এভাবে রেনেসাঁস ও শিল্পবিপ্লবের জন্মভূমি ইউরোপের মানুষদের স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বিপুল সাধারণ মানুষ তাদের সমষ্টির স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা দুটোই হারাল। এই ঘটনা অবলোকন করে, পশ্চিমের বিবেকবান সচেতন ব্যক্তিরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এ ক্ষেত্রেও সমাজের অগণিত মানুষের স্বাধীনতা হরণের মূল কারণ হয়ে উঠল ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রহেলিকা। সেটি কীভাবে হলো এবং সমাজে কীভাবে তার প্রতিফলন ঘটল, সে বিষয়ে এখন কথা বলব।

তিন
শিল্পবিপ্লবের পর পশ্চিমা বিশ্বে, সমাজের মুষ্টিমেয় সংখ্যক বণিকশ্রেণির লোকদের উদ্যোগে আধুনিক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার মাধ্যমে যে শিল্প-সভ্যতার যাত্রা শুরু হলো, সেখানে কারখানার শ্রমিকদের স্বাধীনতা হরণ করে তার ওর প্রতিষ্ঠিত হলো কারখানার মালিকের (শিল্পপতির) একচ্ছত্র ব্যক্তিস্বাধীনতা। এর ফলে কারখানা মালিকের ব্যক্তিস্বাধীনতার বোধ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শ্রমিকদের সমষ্টিগত এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বোধ থেকে। বহু শ্রমিকের যৌথ স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা দুটোই বলি হলো মালিকের ব্যক্তিস্বাধীনতার বেদিতে। একজন শিল্পপতি তখন শুধু কারখানার মালিকই নয়, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিস্বাধীনতারও মালিক। তখন কারখানা চলে মালিকের একচ্ছত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর ভর করে। পণ্য-উৎপাদন কীভাবে হবে, উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ বা বণ্টনব্যবস্থা কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার শুধু কারখানার মালিকের হাতে। সেখানে শ্রমিকদের সিদ্ধান্ত বা মতামতের কোনো স্থান নেই। কারণ তাদের সব ধরনের স্বাধীনতা চাপা পড়ে গেছে শিল্পপতির একচ্ছত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার নিচে।

অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্য বাজারে প্রবেশ করার ফলে নানাবিধ কারণে শিল্পপতির ব্যক্তিস্বাধীনতা আরও একচ্ছত্র, শক্তিশালী হয়ে উঠল। কারণ সে তখন শুধু শিল্পপতি নয়, পুঁজিপতিও। শিল্প-সভ্যতার ওপরতলায় অবস্থানকারী পুঁজিপতির পুঁজির পুঞ্জীভবন ও টিকে থাকার প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠল তার ব্যক্তিস্বাধীনতা, অর্থাৎ একজন ব্যক্তি-পুঁজিপতির স্বাতন্ত্র্য, কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। এদিকে শিল্প-সভ্যতার শুরুতেই শিল্পপণ্য উৎপাদনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠল মুনাফা অর্জন। মুনাফা অর্জন হয় পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে। তাই পণ্য বিক্রয়ের জন্য যে বাজারব্যবস্থা গড়ে উঠল, তা হয়ে উঠল প্রতিযোগিতামূলক। সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে মুনাফা নিশ্চিত কারার জন্য প্রয়োজন পড়ল নিত্যনতুন উদ্ভাবনার মাধ্যমে পুঁজিপতির ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার। আর সেই স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার একমাত্র অবলম্বন হলো প্রবল ব্যক্তিস্বাধীনতা। অর্থাৎ পুঁজিপতিকে তখন সকলের মতো করে স্বাধীন হলে চলে না। সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অথবা স্বাধীনতা হরণ করে তাকে হতে হয় একান্তই স্বতন্ত্র, শ্রেষ্ঠ স্বাধীন ব্যক্তি। শিল্প-সভ্যতার হিরো। আর এইখানে প্রবল ব্যক্তিস্বাধীনতার হাতে বিপন্ন হলো সমাজের বিপুল মানুষের স্বাধীনতা। 

শিল্প পুঁজিপতি তার যে পণ্য নিয়ে বাজারে ঢুকল, সেখানে টিকে থেকে বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য তাকে কম দামে বেশি পণ্য বিক্রি করতে হয়। ফলে সমস্ত মানবিক আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে যে কোনো ধরনের নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করে কারখানার শ্রমিকদের ওপর নির্মম শোষণ পরিচালনা করতে পুঁজিপতির বিবেকে বাধে না। সমাজের বিপুল শ্রমজীবী মানুষের ওপর এইরূপ অমানবিক, পাশবিক আচরণ, যা ন্যূনতম মানবিকতা ও মনুষ্যত্বকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়- তার উৎস হলো, সমষ্টির স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে একজনের অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা।

-লেখক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //