কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ ও আমাদের মনোযোগ

পৃথিবী নামক গ্রহটি বিচ্ছিন্ন, প্রাচীন এবং অবিরাম পরিবর্তনের একটি স্থান। এর অর্থ হল ভূপৃষ্ঠের ওপর এবং নীচে যা কিছু ঘটে তা একটি চক্রের অংশমাত্র। প্রতিটি পরিবর্তনের জন্য যা জীবনের মৌলিক উপাদান, যেমন কার্বন, নাইট্রোজেন, জীবন্ত প্রাণীকূল, সমুদ্র, ভূমি-এসব কিছুই বায়ুমণ্ডলের একটি চক্রাকার অংশ। এমনকি গ্রহের ভূত্বক পর্যন্ত পুনর্ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই ইকো সিস্টেমে।

নতুন ভূত্বক তৈরির সময় টেকটোনিক প্লেটগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়। সাধারণত মহাসাগরের মধ্যখানে গলিত শিলা শূন্যস্থান পূরণ করতে নীচের আবরণ থেকে ওপরের দিকে উঠে আসে। ফলে পুরাতন ভূত্বক ধ্বংস হয়ে যায় আর যেখানে দুটি প্লেট একসাথে একে অপরকে ধাক্কা দেয় এবং একটি অন্যটি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এই চক্রটি আজ কোটি কোটি বছর ধরে চলে আসছে। গঠনের দিক থেকে আরব উপদ্বীপে গভীর এবং বিস্তৃত পাললিক অববাহিকায় অবস্থিত পারস্য উপসাগর এবং এর চারপাশের জমিগুলোর অবস্থান মাটি থেকে বেশ কিছুটা নীচে বলে গবেষণায় দেখিয়েছেন ভূত্বাত্তিকরা। আর এই অববাহিকার গভীরতায় জৈবপদার্থের তাপ ও চাপের ফলে প্রচুর পরিমাণে তেল ও গ্যাস সৃষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত যা উর্ধ্বমূখী স্বভাবজাত। ফলে এগুলো ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি এসে পাথরে পরিণত হয়। 

৩০ নভেম্বর বিশ্বের সকল দেশের নেতৃবৃন্দ দুবাইতে মিলিত হতে যাচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ মুহুর্তে আমাদের কী করণীয় তা ঠিক করতে। যে দুবাইতে হতে যাচ্ছে কপ২৮ সম্মেলন সে শহরটি ওইসব পাথর দিয়েই নির্মিত। আর এই নগরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য আন ফ্রেমোয়ার্ক কনভেনশনের আদলে কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিজ বা কপ২৮ সম্মেলন।

প্রাচীনকালে আরবীয় প্লেট এবং এর উত্তরে অবস্থিত ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের প্রাথমিক পর্যায়ে সমুদ্রের তলদেশে একটি স্তরের সৃষ্টি হয় যার ফলে পাথরগুলো নীচে না গিয়ে ওপরের দিকে ওঠে আসে। প্রাচীনকালে সমুদ্রের তলদেশে বেশিরভাগই ব্যাসল্টের (একজাতীয় কৃষ্ণধূসর আগ্নেয় শিলা) খোঁজ পাওয়া যায়। এটির ফলে উপরিভাগে পেরিডোটাইট শিলা নামে একটি আবরণ দেখতে পাওয়া যায়। যা সময়ের সাথে সাথে সমুদ্রের তলদেশে পাহাড়ের সৃষ্টি করে।

আমরা জানি অন্যান্য পাহাড়ের মতো হাজর পর্বতও ক্রমশঃ ক্ষয়ের দিকে আগাচ্ছে। এটা পুনর্ব্যবহারযোগ্য এক অংশ হিসেবে ভূ-বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত। এর ক্ষয়ের ফলে তাজা শিলা উন্মোচিত হয়ে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পথকে করে যাচ্ছে সুগম। আর এটিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন "রাসায়নিক আবহাওয়া"। পাথরে থাকা ক্ষারীয় খনিজ পদার্থ বৃষ্টি এবং ভূগর্ভস্থ জলের সাথে বিক্রিয়া করে দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইড দ্বারা সামান্য অম্ল তৈরি করে যা চুনাপাথর তৈরির কার্বনেট খনিজ তৈরি করে। 

রাসায়নিক আবহাওয়া প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড হ্রাসের প্রক্রিয়া খুব দ্রুততার সাথে সংঘঠিত হয় না। বিশেষ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া গাছপালার মাধ্যমে সমুদ্রে শৈবাল এবং ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সঞ্চালিত হয়ে প্রতি বছর বায়ুমণ্ডল থেকে ৩০০ গুণ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারিত হয়ে থাকে। ফলে গাছপালার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই কার্বন আকাশে ফিরে গিয়ে পুনঃব্যবহারযোগ্য হয়ে আবার প্রাণীদের খাদ্যে পরিণত হয়ে মাটিতে থেকে যায় শতাব্দীকাল ধরে। এভাবেই চলতে থাকে ভূতাত্ত্বিক কার্বন চক্র যা অনেকটাই ধীর প্রক্রিয়া সপন্ন। 

সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় তেল কোম্পানি এডনক  উপসাগরের প্রচুর পলি থেকে কার্বন-সমৃদ্ধ তেল এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ভাবনা শুরু করেছে। বিষয়টি নিয়ে ভূতাত্ত্বিকগণ ভাবছেন। ফুজাইরার উপরিভাগে অবস্থিত ওমান উপসাগর আর এখানেই শহরটির অবস্থান। এ অঞ্চলে এডনক পালইট প্রকল্পের আওতায় একটি ওমান ভিত্তিক তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান যেখানে কার্বন ডাই অক্সাইডকে পাথরের গভীরে এমনভাবে ইনজেক্ট করা হবে যাতে খনিজকরণের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় কার্বনেটকে উৎসারিত করবে৷ ‘Adnoc’-এর "লো-কার্বন সলিউশন"-এর প্রধান মুসাব্বেহ আল কাবি, এই দ্রুত খনিজকরণে তার ফার্মের বিনিয়োগকে তেল শিল্পের জন্য একটি বিস্তৃত ডিকার্বনাইজেশন কৌশলের অংশ হিসাবে দেখেন, যার লক্ষ্য "খুব টেকসই উপায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সরবরাহ করা।” বলা হচ্ছে, মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের ফলে ইতমধ্যে আনুমানিক ১ ট্রিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথিবীতে জড়ো হয়েছে যা কিনা বছরে ২০ বিলিয়ন কার্বন নিঃসরণে ভূমিকা রাখছে। আর কার্বন-ডাই অক্সাইডের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ২ ডিগ্রি বেড়েছে। এ কারণে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে একযোগে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। 

আমরা ২০১৫ সালের দিকে যদি ফিরে দেখি তবে দেখব, পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে একমাত্র ভুটান সেসময় ‘নেট জিরো’র ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল আর ভুটানের সাথে একই সুরে আজ এত বছর পর ১০১ টি দেশ একমত প্রকাশ করেছে। সবার কথা একটাই বিশ্বের ৮০ ভাগ  দেশ এই গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ি। এই ‘নেট জিরো’ লক্ষ্য পূরণে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিতেও নেয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। তবে কার্বন নিঃসরণের এসব প্রকল্প অত্যন্ত ব্যয়বহুল । যদিও এসবে কর্মসূচীতে বিশ্ব উষ্ণায়ন কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছে অন্তত ২ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা কমাতে হবে পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে, যেটি প্যারিস সম্মেলনে সবাই অনুমোদন করেছিল। এদিকে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার ধারণা আসন্ন দুবাই সম্মেলনে জি-২০ ভূক্ত কোনো রাষ্ট্র ‘নেট জিরো’ বাস্তবায়নে কার্যকরি পদক্ষেপ নিবে না। 


আন্তঃদেশীয় প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বলছে, যদি সত্যি বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি কমাতে হয় তবে সবচেয়ে কার্যকরি পদক্ষেপ হবে বায়ুমণ্ডল হতে অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড প্রতি বছর অপসারণ করা। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিদদের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, আপনি যদি পরিচালিত বনগুলোকে গণনায় না ধরেন যেগুলোর সম্প্রসারণের জন্য খুব সীমিত পরিসর জায়গা অবশিষ্ট তবে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে দুই হাজারগুণ পরিমাণ কার্বন ছড়ানোর আশংকা রয়েছে। যেখানে ২০২০ সালের টেকসই লক্ষ্যমাত্রায় ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন কার্বনের কথা বলা হয়েছিল। 

বর্তমানে কার্বন হ্রাসের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে টেকসই ও কার্যকরি কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত যা অদূর ভবিষ্যতের জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারে। এই সময়ে যাদের মধ্যে উপলব্ধি আসবে যে কার্বন কমিয়ে বিশ্ব তাপমাত্রা হ্রাস করে পৃথিবীকে আগামির জন্য বাসযোগ্য করা উচিত তারা অবশ্যই এ বিষয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে প্রযুক্তির সহায়তায় সুফল বয়ে আনতে সক্ষমতা দেখাবেন বলে আশা করছি। তবে আল কাবি’র তেল ‘উৎপাদন ও ব্যবহার মুক্ত‘ ভিশন এ মুহুর্তে তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসাতে কার্যকর হবে না যারা কিনা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ দরকার বলে মনে করছেন। 

তেল কোম্পানীগুলির পিছনে দৌড়ানোর একটি কারণ হল যে পৃথিবীর ভূত্বকের ভিতরে এবং বাইরে থেকে তরল জাতীয় পদার্থ সরানোর দক্ষতা কেবল তাদের রয়েছে। তাদের কাছে প্রচুর অর্থও রয়েছে। আর বর্তমানে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ খুব ব্যয়বহুল হওয়ায় কার্বন বাজারের জন্য এ অর্থ অধিক দরকারি! তার মানে ‘নেট-জিরো’ নির্ভরশীল একটি প্রক্রিয়ার বেড়াজালে আবদ্ধিত হয়ে আছে। শুধুমাত্র ইনকোয়েট প্রযুক্তির নির্ভর হয়ে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন অপসারণে ভূমিকা রাখার বিশয়টি গৌণ হয়ে পড়েছে। অথচ জলবায়ু নীতি বিশ্ব জনগণ, সরকার এবং প্রত্যেক দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে গ্রহ চক্রের নবায়ন প্রক্রিয়াকে ব্যহত না করে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়মে কার্বন অপসারণের মধ্যদিয়ে সুন্দর এক বিশ্ব গড়ার কথা বলছে। পরিশেষে আসলেই আমরা কেউ জানি না এটা কিভাবে করা হবে বা আদৌ হবে কী না?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //