নারী: ডুরান্ড লাইনের এপার-ওপার

ডুরান্ড লাইন হচ্ছে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত রেখার নাম। এই ডুরান্ড লাইনের একপাশে যখন নারী স্বার্থ রক্ষার্থে শ্লথ গতিতে হলেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তখন ডুরান্ড লাইনের অন্য পাশে আফগানিস্তানে নেওয়া হচ্ছে নারী অধিকার ক্ষুণ্ণ করার বিভিন্ন ব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী নারীকে অধিকার আদায়ে যে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করতে হচ্ছে তার তুলনামূলক দৃষ্টান্ত তুলে ধরতেই ভারত ও আফগানিস্তানের সমসাময়িক কিছু ঘটনা পত্রস্থ করা হলো এই লেখায়। 

বিশ্বব্যাপী নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ও তাকে দমিয়ে রাখার প্রক্রিয়া তৈলাক্ত বাঁশ আরোহী বানরের কথাই বেশি মনে করিয়ে দেয়। এই উপমহাদেশের পাশাপাশি দুটো দেশের এই তথ্য বৃহত্তর নারী অবস্থানের করুণ চিত্রকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। এর থেকে পরিত্রাণ প্রাপ্তি কি সুদূরপ্রসারী? 

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ১৬ আগস্ট ২০২৩ তারিখে ‘হ্যান্ডবুক অন কমব্যাটিং জেন্ডার স্টিরিও টাইপস’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। তাতে ৪৩টি শব্দের একটি তালিকা দিয়ে বলা হয়েছে, ভারতের বিচারপতিরা যেন রায়ে কোনোভাবে এই শব্দগুলো ব্যবহার না করেন। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, মামলার শুনানি চলাকালে বিচারপতি, আইনজীবী এবং মামলার অংশীজনরাও যেন শব্দগুলো এড়িয়ে চলেন। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, এই শব্দগুলোর মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য বিরাজ করছে। তাই সেগুলো বাদ দিয়ে রায় লেখা-সহ আদালতের যাবতীয় কাজ করতে হবে।

হ্যান্ডবুকে এই ৪৩টি শব্দের বিকল্প শব্দও যুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখন থেকে বিকল্প শব্দগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে। যেমন স্লাট অথবা বেশ্যা বা পতিতা শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। লিখতে বা বলতে হবে সেক্স ওয়ার্কার্স বা যৌনকর্মী। যদিও আদালত থেকে সংবাদমাধ্যম সর্বত্র যৌনকর্মী শব্দের ব্যবহার বহু বছর আগেই চালু হয়েছে। তবু প্রধান বিচারপতি এই পুস্তিকায় অনুশাসন দিয়ে আদালতে সরকারিভাবে বেশ্যা বা পতিতা শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করলেন।

তালিকা অনুযায়ী ‘অ্যাফেয়ার’ কথাটি লেখা বা বলা যাবে না। এর পরিবর্তে ব্যবহার করতে হবে ‘রিলেশনশিপ আউটসাইড অব ম্যারেজ’। ইভটিজিং শব্দটিও লেখা বা বলা যাবে না  এর পরিবর্তে লিখতে হবে স্ট্রিট সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বা রাস্তায় যৌন হেনস্তা। পুস্তিকায় বলা হয়েছে, আনওয়েড মাদার বা অবিবাহিত মা কথাটি লেখা বা বলা যাবে না। এই ক্ষেত্রে শুধু মা কথাটিই ব্যবহার করতে হবে। জারজ সন্তান শব্দাবলির পরিবর্তে ব্যবহার করতে হবে ‘অ-বৈবাহিক সন্তান’ বা ‘একটি শিশু যার পিতামাতা বিবাহিত নয়’। যেমন- হাউস ওয়াইফ বা গৃহবধূ শব্দের ব্যবহার এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। তার পরিবর্তে গৃহিণী শব্দটি ব্যবহার করতে সুপারিশ করা হয়েছে পুস্তিকায়।

পর্যবেক্ষকদের মতে, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার নেওয়ার পর আদালতের কাজে গতি ফিরেছে। সেই সঙ্গে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অনেক সংস্কারও হচ্ছে বিচার বিভাগের কাজকর্মে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২২টি ভারতীয় ভাষায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মূল অংশের অনুবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। 

অন্যদিকে কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী প্রেম সিং তামাং তার রাজ্যের নারী কর্মজীবীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি এক বছরে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ দ্বিগুণ করার ঘোষণার পাশাপাশি নতুনভাবে পিতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। চলতি বছরের ২৬ জুলাই রাজ্যের সিভিল সার্ভিস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সাধারণ সভায় তিনি বলেছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা দেওয়ার জন্য চাকরিবিধিতে পরিবর্তন আনা হবে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে তালেবানের আদেশে গত ২৪ জুলাই সব বিউটি পার্লার বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের নারীদের জন্য এসব বিউটি পার্লার শুধুই রূপচর্চার জায়গা ছিল না, ছিল তার চাইতে অনেক বেশি কিছু। তাই আগামী দিনগুলোতে এগুলোর অভাব তীব্রভাবে বোধ করবেন তারা।

আফগানিস্তানের কয়েকটি রাজ্যে ১০ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে তালেবান সরকার। এই নিষেধাজ্ঞাকে নারী অধিকারের ওপর ‘আরও কঠোর আঘাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিবিসি। গজনি রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্কুলের প্রধান ও স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বলেন, ১০ বছরের ওপর মেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পারবে না। তৃতীয় শ্রেণির ঊর্ধ্বে পড়া মেয়েদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পূর্ব আফগানিস্তানের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে, যেসব মেয়ে লম্বা ও যাদের বয়স ১০ বছরের বেশি তাদের স্কুলে প্রবেশের অনুমতি নেই।’ গত বছর ডিসেম্বরে তালেবান সরকার নারীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নিষিদ্ধ করে। বেশ কিছু সরকার ও জাতিসংঘ এই সিদ্ধান্তের ব্যাপক নিন্দা জানিয়েছিল। গত বছর উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী নেদা মোহাম্মদ নাদিম সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নারী শিক্ষা স্থগিতের আদেশ অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য আপনাদের অবহিত করা হচ্ছে।’

নারীরা কঠোর পোশাকের নিয়ম ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুরুষ আত্মীয় নিয়ে আসার নিয়ম উপেক্ষা করে। তাই এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলে দাবি তালেবানের। ২০২১ সালে তালেবান সরকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে নারীদের ওপর শিক্ষাসহ আরও নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দেশটিতে নারীদের বিনোদনকেন্দ্র, জিম, মেলা, সেলুনে যাওয়া নিষিদ্ধ ও জনসম্মুখে পর্দা করে যেতে হবে। ইতোমধ্যে অনেক নারীকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

প্রায় ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা ফিরিয়ে নিলে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে কট্টরপন্থি তালেবান ১৫ আগস্ট ২০২১ আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। প্রাথমিক আশ্বাস ছিল, তারা তাদের প্রথম শাসনকালের পুনরাবৃত্তি করবে না। মানুষকে অনেক বেশি অধিকার সুরক্ষা দেওয়া হবে, নারীদের উপযুক্ত মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি তালেবান সরকার। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা, যা শুধু নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকারকেই আঘাত করেনি, একই সঙ্গে করছে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তারা বলেছিল, নারীরা পর্দা মেনে পুরুষদের থেকে আলাদা শ্রেণিকক্ষে, নারী শিক্ষকের মাধ্যমে পাঠ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু বছর না যেতেই তালেবান নারীদের উচ্চশিক্ষা বন্ধের নির্দেশ দিল। তালেবান আরোপিত নারীদের মুক্ত চলাচলে এই চরম বাধা বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করেছে।

সুদীর্ঘ সময় ধরে সোভিয়েত আগ্রাসন (১৯৭৯-৮৯), আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৮৯-৯২), আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ছাড়াও দমন-পীড়নকারী তালেবান শাসনের কারণে আফগানিস্তানে চরম মাত্রায় নারী অধিকার বিপর্যয় একটি নির্মম সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে তারা ঘোষণা দেয় যে নারী নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে পারবে না এবং মুখ থেকে শুরু করে পুরো শরীর ঢেকে তাদের বাইরে যেতে হবে। নারীদের ফুটবল, ক্রিকেটসহ সব ধরনের খেলাধুলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

২০২১ সালে ক্ষমতায় এসে এক বছরের মধ্যেই তালেবান ধর্মের দোহাই দিয়ে কন্যাশিশু ও নারীদের জনজীবন থেকে আলাদা করে ফেলেছে। নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার খর্ব করে নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনে নারীর জন্য মন্ত্রীর পদ নেই। পরিবারের কোনো পুরুষের সঙ্গে ছাড়া নারীর বহুদূর পর্যন্ত একা একা ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিবারের পুরুষ সদস্য ছাড়া একা নারীদের কোনো ধরনের সেবা দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে প্রথম তালেবান শাসনের সময়ও ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল নারীশিক্ষাসহ বিভিন্ন মৌলিক ও মানবাধিকার। এই পাঁচ বছর সময়ে অনেক মেয়েশিশু স্কুলে ও কাজে যেতে পারেনি। এভাবে আফগানিস্তানের প্রায় ২ কোটি নারী মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //