শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ণয়ে করণীয় কী

সম্প্রতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকেরা তাদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। তারা মনে করেন, বেঁচে থাকার জন্য তাদের যে ন্যায্য পাওনা, তা থেকে তারা বঞ্চিত। বিশেষত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে যেখানে মধ্যবিত্তেরই নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম, সেখানে তাদের বেতনের পরিমাণ দেখলে এই দাবি অযৌক্তিক ভাবার কারণ নেই। অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নেই বলে নানা সূত্রে জানা যাচ্ছে। 

বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন নির্ধারিত ছিল ৮,০০০ টাকা। অবশ্য সরকার তাদের আন্দোলনকে সম্মান জানিয়ে তা বাড়িয়ে করেছে ১২,৫০০ টাকা। অর্থাৎ সরকার তাদের বেতনের ৫৬.২৫% বৃদ্ধি করেছে। দেশের শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এর সঙ্গে শ্রমিকদের ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্টেরও ঘোষণা দিয়েছেন। সেই হিসাবে বর্তমান সরকার অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। কিন্তু শ্রমিকরা এই ঘোষণাতে সন্তুষ্ট নয়। ইতোমধ্যে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে দুজন শ্রমিক মারা গিয়েছেন এবং ডজন খানেক শ্রমিক আহত হয়েছেন। সরকার ও নীতিনির্ধারক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছেন। পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন জন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কত হতে পারে, সেই বিষয়ে নানা মতামতও ব্যক্ত হয়েছে। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ সম্ভব কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা। 

শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের বিষয়টি একাধারে দর্শন, অর্থনীতি ও নীতিশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বিষয়টির নিষ্পত্তি খুব একটা সহজ নয়। পশ্চিমা দুনিয়াতেও এক এক দেশে শ্রমিকের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মজুরি এক এক রকম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো অঙ্গরাজ্যে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মজুরি এক নয়। আবার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মজুরির পরিমাণ সময়ভেদে ওঠানামাও করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ব ও নিম্নগতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং দ্রব্যের সরবরাহের ও লভ্যতার তারতম্যের ওপরও একটি অঞ্চলের মজুরি ওঠানামা নির্ভর করে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, সরবরাহ বেশি হলেই যে দ্রব্যের দাম কমবে, তা নিশ্চিত নয়। কারণ কালোবাজারিরা এবং অতিরিক্ত লাভের আশায় স্টকাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে দারিদ্র্য সম্পর্কে বহুমুখী পর্যালোচনা আছে, যা মজুরি নির্ধারণের প্রয়োজনীয় আলোচনাতে খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু কার্ল মার্ক্স তার জায়গা থেকে মজুরি সম্পর্কে যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাতে তার মতে, মজুরি নির্দিষ্ট হয় শ্রমিক ও মালিকের রেষারেষির মধ্য দিয়ে। এই আলোচনা শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কত হওয়া উচিত, তা বোঝার ও নির্ধারণের জন্য প্রাসঙ্গিক। তবে বলে রাখা ভালো, মার্ক্স আলোচনাটি প্রথম করেছিলেন ১৮৪৪ সালে। ইউরোপে তখনো কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা অস্তিত্ব লাভ করেনি। 

মার্ক্স লিখেছেন, “মজুরি নির্ধারিত হয় পুঁজিপতি এবং শ্রমিকের পারস্পরিক শত্রুবৎ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। পুঁজিপতিদের জন্য বিজয়টা জরুরি। পুঁজিপতিকে ছাড়া শ্রমিক যত দিন বেঁচে থাকতে পারে, পুঁজিপতি শ্রমিককে ছাড়া তার চেয়ে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে। পুঁজিপতিদের নিজেদের মধ্যকার ঐক্য স্বাভাবিক ও কার্যকর, যা শ্রমিকের ঐক্যকে নিষিদ্ধ এবং পরিণতি ভয়াবহ বলে প্রতীয়মান করে। এ ছাড়া ভূমিমালিক ও পুঁজিপতি রাজস্বকে তার শিল্পের অনুকূলে খাটায়, এ ক্ষেত্রে শ্রমিকের শিল্প থেকে আয়, ভূমির খাজনা বা পুঁজি থেকে প্রাপ্ত সুদ কোনোটাই নেই, যা দিয়ে সে তার আয় বাড়াতে পারে। যে কারণে শ্রমিকদের নিজেদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় অনেক বড় আকারে।” মার্ক্স আরও লিখেছেন, “শ্রমিকের জন্য ঐ পরিমাণ ন্যূনতম প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ হয়, যা দিয়ে সে কাজ নির্বাহকালে বেঁচে থাকতে পারে, আর যাতে সে তার পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারে এবং শ্রমিকদের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় সে বিলুপ্ত না হয়।” মার্ক্সের এই কথাটি কমবেশি আজো ঠিক তৃতীয় বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে। পুঁজির প্রথম খ-ে মার্ক্স উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বের আলোচনায় বলেছিলেন, শ্রমিক তার সারাদিনের অর্জিত শ্রমশক্তি মালিকের কারখানায় ব্যয় করে, অথচ তাকে মজুরি দেওয়া হয় কারখানাতে থাকাকালীন শ্রমঘণ্টার হিসাবে। আবার সমান দক্ষ নয় এমন দুই শ্রমিকও একই মজুরি পান।

শ্রম একটি বিমূর্ত ধারণা। শ্রমিককে তার কর্মঘণ্টা হিসেবে মজুরি দেওয়া হয়। নিউটনীয় মেকানিক্সে, কাজ = বল দ্ধ সরণ। অর্থাৎ প্রযুক্ত বল এবং তার কারণে বস্তুর স্থানান্তরের পরিমাণকে গুণনের মাধ্যমে কাজের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। গাণিতিকভাবে পরিমাণ নির্ধারণের সময় এতে একক যুক্ত হয়। যেমন- এক নিউটন বল প্রয়োগে কোনো বস্তুর এক মিটার সরণ ঘটলে কাজ হবে এক নিউটন-মিটার বা এক জুল। কিন্তু মানুষের কায়িক শ্রমজাত কাজের বিষয়টি মূলত শারীরবৃত্তীয় এবং তাতে কোনো কিছুর সরণ নাও ঘটতে পারে। একজন ব্যক্তি যে শ্রম দিয়ে এক ঘণ্টায় একটি কাজ করতে পারেন, অন্য একজন ব্যক্তির তা সম্পন্ন করতে তাকে দ্বিগুণ শ্রম দিতে হতে পারে। কিন্তু প্রচলিত হিসাবে তারা একই মজুরি পাচ্ছেন। একই কাজ করতে ব্যক্তি ভেদে শ্রমের বিভিন্নতার কারণ শারীরিক ও মানসিক শক্তি এবং ধীর তারতম্য, খাদ্যের এবং জীবনযাপনের বিভিন্ন উপায়-উপকরণের পার্থক্যের কারণে হয়। আবার বয়স ও শারীরিক সক্ষমতার তারতম্যেও (যেমন কেউ অসুস্থ থাকতে পারেন) একই শ্রমঘণ্টায় দুই ব্যক্তির প্রয়োগকৃত শ্রম ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু মজুরি নির্ধারণের বেলায় এর সব কয়টি বিষয় উন্নত বিশ্বেও ধর্তব্য নয়, হয়তো তা সম্ভবও নয়। এরপর রয়েছে পরিবারের হিসাব। দুজন শ্রমিকের একজনের আয় দিয়ে পাঁচ সদস্যের পুরো পরিবার চলে, আর একজনকে শুধু নিজের খরচটা চালাতে হয়। তাতে মালিক চাইলেইবা কতটা সুবিধা পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া ব্যক্তিটিকে দিতে পারেন? মালিককে এ ক্ষেত্রে দোষও দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের একজন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক আমাকে জানালেন যে, অনেক সময় শ্রমিকরা অগ্রিম বোনাস চান, কিংবা সদ্য আগত শ্রমিকও বোনাস, ভাতা দাবি করেন। অথচ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিকরাও যুদ্ধবিগ্রহ ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চাপের মুখে আছেন। 

এবার আসি দারিদ্র্যের বিষয়ে। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের আগে বেশিরভাগ ব্যক্তির, পরিবারের বা গোষ্ঠীর দারিদ্র্য নির্ধারক পারমাপকগুলো ছিল বস্তজাগতিক অর্জন (শিক্ষাও তার মধ্যে পড়ে) ও ভোগকেন্দ্রিক। মাল্টিডিমেনশনাল পোভার্টি ইনডিসেস ও (এমপিআই)-এর বাইরে নয়। সেন সেখানে কল্যাণ ও মানসিক সন্তুষ্টির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেছেন। ভোগকেন্দ্রিক জায়গাগুলো থেকে ন্যূনতম মজুরির বিষয় দেখলে দেখতে হচ্ছে, তা দিয়ে শ্রমিক ও তার পরিবার প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণের 

জোগান দিতে পারছেন কিনা? আমরা জানি যে, আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য রেখা (ইন্টারন্যাশনাল পোভার্টি লাইন) দিয়ে দারিদ্র্য নির্ণয় প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ এটি ডলারে নির্ধারিত দৈনিক সর্বনিম্ন একটি আয়ের নিচে কোনো ব্যক্তি আয় করলে তাকে চরম দরিদ্র বলে বিবেচনা করে। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাংক আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য রেখা নির্ধারণ করেছিল ১.৯০ থেকে ২.১৫ ডলারের মধ্যে। কিন্তু জিনিসের দামের তারতম্য স্থানভেদে কখনো প্রবল হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্যোগ আক্রান্ত জায়গায় তা হয় প্রবলতর। এমনকি টাকা দিয়েও সব সময় খাবার ও জিনিসপত্র মেলে না। ক্যালরি ইনটেক অ্যাপ্রোচ আরও খারাপ। দৈনিক একটি নির্ধারিত পরিমাণ বা তার বেশি ক্যালরি মানুষ খাবারের সঙ্গে নিতে পারলেই সে আর দরিদ্র নয়। অথচ ব্যক্তিভেদে একই খাদ্য দিয়ে শরীরের ক্ষয়পূরণ বা অ্যানাবলিজম এবং তার ক্ষয়সাধন বা ক্যাটাবলিজম রোধকরণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। শরীরের আকৃতিভেদে এক একজন ব্যক্তির শারীরিক গড়নও হয় ভিন্ন ভিন্ন এবং ক্যালরির প্রয়োজনও সেইমতো এক এক পরিমাণের। আর দারিদ্র্যের অন্যান্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ তো এই খোঁড়া অ্যাপ্রোচে আসেইনি। মোটা দাগে বললে, এটি এখন স্বতন্ত্র অ্যাপ্রোচ থেকে বেসিক নিডস অ্যাপ্রোচের (মৌলিক চাহিদা পদ্ধতি) অনেকগুলো ইনডিকেটরের একটিতে পরিণত হয়েছে। অমর্ত্য সেন বেসিক নিডস অ্যাপ্রোচকেও খারিজ করে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, হয়তো কোনো একজন ভারতীয় সাধু খাবার খান না, বস্ত্রও পরিধান করেন না। এই বিবেচনায় তাকে দরিদ্র বলা যাবে না। কারণ তিনি চড়েন আবার বিএমডব্লিউ গাড়িতে। সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ অনুসারে, ব্যক্তি যা করতে চায় বা যা হতে চায় (তার চয়িত শব্দে ব্যক্তির আকাক্সিক্ষত ‘ডুইংস অ্যান্ড বিংস’), তা সে করতে বা হতে পারলেই সে দরিদ্র নয় বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু এই তত্ত্বের বিচারে দারিদ্র্য অলঙ্ঘনীয়। অর্থনীতি বলে, মানুষের চাহিদা অসীম, কিন্তু জগতে সম্পদ সীমিত। সে ক্ষেত্রে বেসিক নিডস অ্যাপ্রোচকেই আমরা গ্রহণ করতে পারি। এখন দেখা যাক, কোনো শ্রমিকের ও তার পরিবারের তার ওপর নির্ভরশীল সদস্যদের মৌলিক চাহিদা পূরণে মাসিক সর্বনিম্ন কত খরচ হতে পারে। অবশ্যই স্থানভেদে তার তারতম্য ঘটে। সে বিবেচনায় এনেই বাংলাদেশে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হওয়া উচিত। তবে শ্রমিকের যোগ্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য পুরো আলোচনাটির পর্যালোচনাই জরুরি।

লেখক: রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //