টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন নিয়ে কিছু কথা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনের ২ নভেম্বরের সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ‘শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে একটি বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা রয়েছে। সেপ্টেম্বরে চার্লি ক্যাম্পবেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তার ভিত্তিতে রচিত এই প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনাকে লৌহকঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী শেখ হাসিনা দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বৈপ্লবিক ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টার কথা উল্লেখ রয়েছে, রয়েছে বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাত, পুলিশের গাড়ি ও পাবলিক বাসে আগুন লাগানোর কথা, বলা হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের কথা। শেখ হাসিনার সমালোচকদের ক্রমবর্ধমানভাবে টার্গেট করার জন্য বাংলাদেশের বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করা ছাড়াও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে লাগাতার বিচারিক হয়রানির উল্লেখও রয়েছে ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে, উল্লেখ রয়েছে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বিশ্বব্যাপী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও ইরানের অবস্থান ১৪৭তম। 

দুর্নীতির ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান এত খারাপ, বিশ্বাস হয় না। কয়েক যুগ আগেই ইরানে শরিয়া আইনের প্রবর্তন হয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা কি তাহলে কাজ করছে না? অপরাধীর অভাবে নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেনে জেলখানা উঠে যাচ্ছে, আর আমরা নতুন নতুন জেলখানা তৈরি করছি। তবে বাংলাদেশে দুর্নীতি আগের তুলনায় কমেছে। কারণ ইতিপূর্বে বিএনপির আমলে বাংলাদেশ পরপর ৫ বার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দুর্নীতি রোধ করার শপথ নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসে, কিন্তু তারাই আবার দুর্নীতির বদনাম নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির আমল ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা জঘন্য বিবেচিত হলেও বিএনপি এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু না করলে বাংলাদেশ এত দিনে নরকে পরিণত হতো। আওয়ামী লীগের আমলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তবে বহির্বিশ্বের চাপে এখন আর খুব একটা শোনা যায় না। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিচারিক হয়রানির কথা বলার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না; কারণ প্রচলিত আইনেই তার পরিচালনাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন মোতাবেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস; এমনকি বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির শীর্ষ দেশও আমেরিকা। আমেরিকার সঙ্গে বিবাদে জড়ানোর আগে টাইম ম্যাগাজিনের এই বক্তব্য আমাদের মনে রাখা দরকার। এ ছাড়াও আমাদের আরও ভাবতে হবে, জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ শীর্ষে, ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের ঋণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, পোশাক রপ্তানির প্রধান গন্তব্যস্থল আমেরিকা এবং ইউরোপ। আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘ এবং ইউরোপের ওপর আমেরিকার প্রভাব সর্বাধিক। 

মনে রাখতে হবে, সরকার রাশিয়া আর ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বললে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৃষ্টিকটু দৌড়ঝাঁপ আরও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি আমেরিকাকে তুষ্ট রাখতে হামাসদের ওপর ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা বর্ষণের বিরুদ্ধে একটি 

কথাও বলছে না, এই বিষয়ে তাদের সমর্থকরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একেবারে নিশ্চুপ। 

টাইম ম্যাগাজিনের পর্যালোচনা থেকে অনুমিত হয়, চীনের ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক ভূমিকা হ্রাস করতে আমেরিকা উঠেপড়ে লেগেছে এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি টেস্ট কেস হিসেবে গণ্য করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উছিলা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে, এই উন্নয়নের পেছনে চীনেরও অবদান রয়েছে। কিন্তু আমেরিকার ভয়ে চীনের অর্থ নেওয়া যাবে না। আমেরিকা একদিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হরণ করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা গণতন্ত্র নয়, বাংলাদেশে একটি পুতুল সরকার চায়। 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের দুর্বিষহ জীবনের কথা টাইম ম্যাগাজিনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বক্তব্য অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। সম্পদশালী ও তেল উৎপাদক দেশগুলোর পক্ষে এই মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়া সম্ভব হলেও আমদানিনির্ভর দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব হয়নি, শীঘ্র হবে বলেও মনে হয় না। বাংলাদেশ যা রপ্তানি করে তার দ্বিগুণ মূল্যের পণ্য আমদানি করে। আমদানি খাতে বিশ্ব বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় একই পরিমাণ পণ্যের জন্য আমাদের দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক অবরোধ বন্ধ না হলে বিশ্বের অর্থনৈতিক অস্থিরতা দূর হবে না, এর ফলে মূল্যস্ফীতি কমবে না, আমদানিনির্ভর দেশগুলোতে উন্নয়নের গতি ক্রমান্বয়ে থেমে যাবে। সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়েও টাইম ম্যাগাজিনে প্রধানমন্ত্রীর মতামত তুলে ধরা হয়েছে। এই আইনের বিরুদ্ধে কমবেশি সবাই সোচ্চার। কিন্তু ডিজিটাল যুগে সাইবার ক্রাইম বেড়ে গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা আর গুজবের বিস্তার, মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ক্ষীণতর, সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে; তাই সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির জন্য আইন দরকার। সরকার পরিচালনায় এমন আইনের অপরিহার্যতা বিরোধী দল স্বীকার করে না, ক্ষমতায় গিয়ে কিন্তু ওই সকল আইন বাতিল করে না। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন নিয়ে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি সমালোচনায় মুখর; কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা এই আইন বাতিল করেনি। টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার বিভিন্ন অর্জনকে চিত্তাকর্ষক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পত্রিকাটির বক্তব্য হচ্ছে, ২০০৬ সালে বিএনপির আমলে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৭১ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে আওয়ামী লীগ আমলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। সত্যি চমকপ্রদ উন্নয়ন। বৈশ্বিক জিডিপির তালিকায় ৩৫তম অবস্থানে বাংলাদেশ, আর পাকিস্তানের অবস্থান ৪২তম। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর বঙ্গবন্ধু অর্থনীতির যে ভিত তৈরি করে দেন তার ওপর দাঁড়িয়ে দেশ এগোতে থাকে, কিন্তু বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নের একটা উল্লম্ফন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট বর্তমানে ৭ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ানো হচ্ছে। দুই কোটি মানুষের ঢাকা শহরে এখন আর ওয়াসার পানির জন্য কাউকে হাহাকার করতে হয় না। 

টাইম ম্যাগাজিন আরও যা যা উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে, দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ মেয়ে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে, মেয়েদের ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে পদার্পণ করে বেকার সমস্যার সমাধান করেছে, ধান-চাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়নি তা হলো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় লক্ষ লক্ষ গরিব, নিঃস্ব, বিধবা, প্রবীণের নিকট প্রতি মাসে বিনে পয়সায় খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা কম পয়সায় চাল-ডাল-তেল কেনার সুযোগ পাচ্ছে, হতদরিদ্র শত শত পরিবার বাড়ি-ঘর পাচ্ছে। ২০১৬ সালের পহেলা জুলাইতে হলি আর্টিজানে বিদেশি এবং কোরআন পড়তে অক্ষম কাস্টমারদের ওপর ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি তুলে ৫ জঙ্গির বোমা, পিস্তল, অ্যাসল্ট রাইফেল, রামদা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কাহিনিও টাইম ম্যাগাজিনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষ লেখক এবং ব্লগারদের লক্ষ্য করে ৩০টিরও বেশি সহিংস হামলার উল্লেখ রয়েছে টাইম ম্যাগাজিনে। বাংলাদেশ উগ্র মৌলবাদীদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হওয়ার মুখ্য কারণ হিসেবে টাইম ম্যাগাজিন ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে শুরু হওয়া ‘ইসলামিফিকেশন’ এবং ১৯৮৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করাকে দায়ী করেছে। কথাটি অসত্য নয়। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করায় বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতায় বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন বামপন্থি এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। তবে ধর্মের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসা অন্য নেতাদের মতো রাজনৈতিক নয়; তার এই ভালোবাসা শুধু ৫৬০টি দৃষ্টিনন্দন ও ব্যয়বহুল মসজিদ নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ। এই একনিষ্ঠতার প্রমাণ পেয়েছি আমাদের ব্যাংকনোট ডিজাইন করার সময়; তার নির্দেশেই একাধিক নোটে মসজিদের ছবি রাখা হয়েছে। 

টাইম ম্যাগাজিনের মতে, ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনার বড় সাফল্য পুনরুত্থিত ইসলামপন্থি জঙ্গিদের পরাস্ত করার পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর দেশের শাসন ক্ষমতায় অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে সমর্থ হওয়া। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্যাপক জনসমর্থন থাকায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা সহজ নয়; শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনেও জিতবেন। কারণ ‘জনগণ তার প্রধান শক্তি’। 

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //