পরাশক্তির কূটনীতির কাছে পরাজিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না

নির্বাচন সামনে রেখে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে যা ভাবা হয়েছিল তেমনটাই হচ্ছে। ২৮ অক্টোবর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে দেশ একদিকে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, অপর দিকে হত্যা-খুন ও অগ্নিসন্ত্রাসও চলছে। জনগণের মনোভাব, সরকারের অবস্থান, বিএনপি ও জামায়াতের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা প্রভৃতি থেকে অনুমান করা যাচ্ছে, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন সম্পন্ন হবে। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে যোগ দেবে।

তবে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বয়কট করে হরতাল, অবরোধ কতটুকু চালাতে পারবে, হত্যা-খুন ও অগ্নিসন্ত্রাস-নাশকতা কী রূপ নেবে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যোগ দেবে কি না, তা নিয়ে আগাম কিছু বলা অসম্ভব।

তবে ধূম্রজাল যে সৃষ্টি হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২৮ নভেম্বর ও তারপর হত্য-খুন, অগ্নিসন্ত্রাস-নাশকতা কতটুকু কী হয়েছে কিংবা কে বা কারা তা করেছে বর্তমান ডিজিটাল যুগে আড়াল করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ঘটনার পর পরই কিছু ভাইরাল ছবি দেখার সুযোগ দেশবাসীর হয়েছে। কয়েকজনের ছবিসহ নামও প্রকাশ পেয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, একাধিক পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ এবং তিনজন পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া, পুলিশ সদস্যসহ কতক মৃত্যু প্রভৃতি ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শতাধিক চিহ্নিত করেছে বলে জানা গেছে।

সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে তোলা ফুটেজ রাজধানীসহ দেশের সব থানায় পাঠানো হয়েছে। সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করতে দেশবাসীরও সাহায্য নেওয়া হচ্ছে; যাতে অপরাধীরা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, সে ব্যবস্থাও সরকার নিয়েছে। জানা যায়, ফুটেজ যাচাই করে দেখা গেছে, হামলাকারীদের মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক বছিরুল ইসলাম খান রানা, বনানী থানা ছাত্রদলের সহসভাপতি লুৎফর রহমান বাবর ও মিরপুর যুবদলের আহ্বায়ক তুহিন মিয়া। তা ছাড়া তাণ্ডবে জড়িত নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতা মাসকুল ইসলাম রাজীবসহ আড়াইহাজার থানার কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ফুটেজের ছবি প্রকাশ পেলে এবং দোষীরা গ্রেপ্তার হতে থাকলেও তা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। ফলে বিএনপির কী লাভ হচ্ছে বলা কঠিন। তবে লাভবান হচ্ছে দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূরা; যারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক খপ্পরে ফেলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর জাতিসংঘের বিবৃতি হচ্ছে এর প্রমাণ। জাতিসংঘে মানবাধিকারে সোচ্চার আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দেশের প্রতিদিনকার রাজনীতিতে যেভাবে জড়িত হয়ে আছেন, তা থেকে এমনটা অনুমান করা খুব একটা সহজ ছিল না। 

আমেরিকার এই তৎপরতা কতদূর পর্যন্ত গেছে তা অনুধাবন করা যাবে, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তথাকথিত উপদেষ্টা মিয়া জাহিদুর ইসলাম ওরফে আরেফি নাটকে। এই নাটক হতোই না যদি পিটার হাস দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এতটা নাক না গলাতেন। অর্থাৎ এই নাটক সৃষ্টির দায় প্রধানত পিটার হাসের। নাটক শুরু হয় ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যার পর ‘বাইডেনের উপদেষ্টা’র বিএনপি অফিসে যাওয়া, বিএনপির অভ্যর্থনা ও নেতাদের গদগদ হওয়া ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলন করার ভেতর দিয়ে। 

আর নাটক শেষ হয়, পালানোর সময় বিমান বন্দরে আরেফির গ্রেপ্তার ও স্বীকারোক্তি এবং বিএনপি নেতা অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের ভেতর দিয়ে। বাস্তবে বিএনপি এই নাটকে ধরা খেয়েছে। এর সঙ্গে পিটার হাসের তৎপরতার সামঞ্জস্যতা থাকায় ধরা খাচ্ছে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি আমেরিকাও। বাংলাদেশ অবশ্য চায় না, বিশেষত বৃহৎ শক্তি যারা আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির সহযোগী, তারা বিতর্কিত হোক।

বাংলাদেশ পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অনুসৃত নীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে শত্রুতা নয়’ নীতি অনুসরণ করে চলছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতা করেছে, যার মধ্যে আমেরিকাও রয়েছে, স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তৎপর ছিল। দ্রুতই স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু পরাশক্তি এমনই যে, বাস্তবতার কারণে কখনো কখনো পিছিয়ে এলেও সুযোগ বুঝে বাগে ফেলে প্রতিশোধ নিতে ছাড়ে না।

১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর কিউবার কাছে পাট রপ্তানি করার অজুহাতে আমেরিকা চুক্তি অনুযায়ী খাবার পাঠায়নি। যদিও এসব ক্ষেত্রে অন্য অনেক দেশকে ছাড় দেয়, কিন্তু বাংলাদেশকে দেয়নি। তদুপরি বাংলাদেশকে বলেছে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি। বাস্তবে কিসিঞ্জার তখন যা করেছিলেন, এখন সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন পিটার হাস। তখন ছিল খাদ্য, বিশেষত অর্থনীতির ইস্যু আর ভেতরে ভেতরে ছিল রাজনীতি, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। আর এখন সরাসরি রাজনীতি হয়েছে ইস্যু, ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থও আমেরিকা গোপন রাখছে না।

হত্যা-ক্যুর ভেতর দিয়ে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনীতিতে একটা প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে, দেশে গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির নানা সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও টানাপড়েন নিয়ে চললেও ভালো, নাকি বিদেশিদের নাক গলানো ভালো? ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার বিধি সংযুক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই সংশোধনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়নি। এর ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দেশের ভেতরের কোনো অশুভ শক্তি ক্ষমতা দখল করুক-এমনটা দেশবাসী চায় না এবং তা দেশের জন্য চরম ক্ষতিকর। 

তবু বাতাসে এমন কথাও ভাসে, বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগে এখনকার অরাজকতা-অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আবারও ওই পথে দেশকে ঠেলে দেওয়া। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসার কারণে গুরুত্ব বাড়ায় এখন দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থবাদীরা বাংলাদেশের পিছে লেগেছে। 

এটা তো অজানা নয় যে, কোনো সুনির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের মৌলিক কাঠামো (বেসিক স্ট্রাকচার) যদি উপরি কাঠামোর (সুপার স্ট্রাকচার) সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয় কিংবা অন্তত গতি যদি সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ার দিকে যায়, তবে সেই দেশ মুখ থুবড়ে পড়ে, বিপদাপন্ন হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আমলে হয়েছে এক ধরনের সমস্যা আর বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমলে রয়েছে ঠিক উল্টো ধরনের সমস্যা। কারণ বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি আর তার কন্যা পেয়েছেন সামরিক কর্তা জাত বিএনপি ও এর সঙ্গী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের মতো বিরোধী দল। 

স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও তার অঙ্গীকার অনুয়াযী সংবিধান রচনা করেন এবং দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতীয় চারনীতি সামনে রেখে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধু রাজনীতির দিক থেকে বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে সামনের সারিতে নিয়ে আসেন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনীতি ছিল পিছিয়ে। ছিল না অর্থ-খাদ্য। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি এগিয়ে যায়, অর্থনীতি থাকে মহা সংকটের মধ্যে পিছিয়ে। 

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধু কথিত ‘চাটার দল’-এর কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আর ‘রাতের বাহিনী’ অর্থনীতিকে আরও আঘাত করার জন্য বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তোলে এবং বাজার-হাট-থানা-ফাঁড়ি লুট করতে নামে। এর মধ্যেই আসে ভয়াবহ বন্যা। সাথে সাথে শুরু হয় কিসিঞ্জারি কূটনীতি। তখন পিছিয়ে থাকা অর্থনীতিকে পুঁজি করে রাজনীতি তথা সংসদীয় গণতন্ত্রকে আঘাত করা হয়। ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত জানা কষ্ট হলেও বলতে হয়, এই প্রশ্ন অনেকেই করতে চান না, ‘চাটার দল’ ও ‘রাতের বাহিনী’র তৎপরতার বাড়বাড়ন্ত না হলে কি সংসদীয় গণতন্ত্রের স্থলে একদল হতো? আসলেই হতো না।

ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গা দিয়ে গড়িয়ে গেছে অনেক পানি। ১৯৮১ সালে দেশ যখন হত্যা-খুন আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের ঘূর্ণাবর্তে, তখন জীবনকে হাতের মুঠোয় রেখে দেশের বৃহত্তম দল নেতৃত্বশূন্য আওয়ামী লীগের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি প্রথম থেকেই ‘ভোট ও ভাতের’ অধিকারে দাবি তোলেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ধারাবাহিকতা, দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক। 

এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয় ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। ভাত সুনিশ্চিত করে ভোটের রাজনীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে তিনি দেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা ছেড়ে দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। কিন্তু কী করেছিল তখন বিএনপি-জামায়াতের পুতুল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান! সা-ল-শা সরকারের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের কথা দেশবাসী কখনো ভুলে যাবে না।

এরই পরিণতিতে ২০০১ থেকে ২০০৮ প্রথমে খালেদা-নিজামী ও পরে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের শাসনামল ছিল ভোট ও ভাতের অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বপ্নভঙ্গের সময়কাল। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার প্রধান টার্গেটই ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। জাতি সেই সময়কাল পার হয়ে এসেছে। পরের ১৫ বছরে দেশ এখন আবারও সেই ভোট ও ভাতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথেই অগ্রসর হচ্ছে।

কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা বঙ্গবন্ধুর সময়ের ঠিক বিপরীত। দেশ এগিয়ে গেছে অর্থনৈতিকভাবে আর রাজনৈতিকভাবে আছে পিছিয়ে। বিএনপি-জামায়াত যদি হয় প্রতিপক্ষ, তবে জাতির কপালে তা ভিন্ন আর কী থাকতে পারে! তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় শেষ পেরেক পুঁতেছিল যে দুই দল, সেই বিএনপি ও জামায়াতই এখন ওই দাবি তুলে জনমতকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ খোঁজে। আদালতের রায়ে সংসদ কর্তৃক সংশোধিত সংবিধানও মানে না ।

এই কারণেই এখন সুযোগ পাচ্ছে আমেরিকা। কিসিঞ্জার পিছিয়ে থাকা অর্থনীতিকে পুঁজি করে রাজনীতিকে আঘাত করেছিলেন। আর তার চাইতে পদমর্যাদায় ক্ষুদ্র পিটার হাস রাজনীতিকে পুঁজি করে দেশের অগ্রযাত্রাকে করতে চাচ্ছে আঘাত। আঘাতে আঘাতে দেশ এখন ইস্পাতের মতো শক্ত। এবারে পরাশক্তির কূটনীতির কাছে হেরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ঘোলা পানিতে কাউকেই মৎস্য শিকার করতে দেবে না জনগণ।


শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //