গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণে উপেক্ষিত নারী

বেসরকারি টিভি চ্যানেলে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেছেন এক সাংবাদিক। ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন বেশ কয়েকজন সুপরিচিত সম্পাদক। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে একজন বলে বসলেন, অনেক দিন থেকেই তো সাংবাদিকতা করছেন। আর দরকার কী? এখন মনোযোগ দিয়ে ঘরসংসার করেন। বয়স তো হয়ে যাচ্ছে তাই না? তার কথায় প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেন সেই সাংবাদিক। বলতে চেয়েও বলতে পারেননি, আপনি তো আমার চেয়ে কমপক্ষে ২০ বছরের বড়। আপনি তাহলে এখনো আছেন কেন? ক্ষুব্ধ হয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি ।

সাংবাদিক নাদিরা কিরণ বলেন নারীরা একটু সিনিয়র হলেই তাদের আর মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ অনেক পুরুষের ক্ষেত্রে হয় ঠিক এর উল্টো। দেখা যায় বর্ষীয়ান সাংবাদিক হাঁটতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, তবু তাকে নেওয়া হয় সম্পাদক করে। অথচ সেখানে একজন নারী যোগ্য হলেও তাকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এই পেশায় আসা নারীরা অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, সারা দেশে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও নারীদের বৈষম্য ও মানসিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রবণতা ও অবদমনের মাত্রা এখনো আশানুরূপ কমেনি। সেই অতীতেও ছিল বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতে কতটুকু কমবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা। 

জানা যায়, ১৯৮৭ সালে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক মিলিয়ে বাংলাদেশে ২৪১টি পত্রিকা প্রকাশ হতো। সে সময় নারী সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ জন আর পুরুষদের সংখ্যা ছিল ৯০০। সেই সময় ‘বেগম’-এর সম্পাদক নূরজাহান বেগম ছাড়া আর কোনো প্রবীণ নারী ব্যক্তি ছিলেন না বড় কোনো পদে। 

সরকারের ২২ সালের তথ্যমতে সারাদেশে নিবন্ধিত পত্রপত্রিকার তালিকা ৩ হাজার ১শ ৭৬টি। এসব পত্রিকায় পুরুষরাই বেশি কাজ করেন। এই ২০২৩ সালেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর সংখ্যা যে সন্তোষজনক হারে বেড়েছে তাও নয়। নারী সম্পাদক আছেন হাতেগোনা। যারাও বা আছেন তাদের অনেকেরই পারিবারিক সূত্রে ক্ষমতায়ন। ফলে নারীদের গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করাটা সোনার হরিণের মতোই। 

বছর দশেক আগে এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ঢাকা শহরে কর্মরত দেড় হাজার সাংবাদিকের মধ্যে মাত্র নারী ছিলেন ৬০ জন। অর্থাৎ মোট সাংবাদিকের চার শতাংশ। টিভি চ্যানেল ও দৈনিক পত্রিকা বৃদ্ধির কারণে এ সংখ্যা বর্তমানে বেড়েছে। তবে গণমাধ্যমে কতজন নারী সাংবাদিক কাজ করছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান আজও জানা যায়নি। 

সিনিয়র সাংবাদিক নাসিমুন আরা মিনু বলেন, একটু সিনিয়র হয়ে গেলেই নারীদের আর কর্মক্ষেত্রে রাখতে চায় না কর্তৃপক্ষ। অথচ তার চেয়ে সিনিয়র পুরুষ সাংবাদিকদের কদর দিন দিন যেন বাড়ে। সংকীর্ণ এই মানসিকতার বেড়াজাল ভাঙতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে নারীরা তাদের যোগ্যতা দিয়েই প্রতিটি পেশার পাশাপাশি কাজ করছেন সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায়। অথচ তাকে ইচ্ছে করে পিছিয়ে রাখা সত্যিই অনুচিত। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নারীর অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে নারীর মূল্যায়ন হচ্ছে কি? 

পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইনে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মেয়েরা তেমন নেই বললেই চলে। একপ্রকার যুদ্ধ করেই টিকে আছেন তারা। 

একুশে টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক রাশেদ চৌধুরীর মতে, নারীরা পেশার ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান, একাগ্র। আর সে কারণেই তারা দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য। তবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীদের সামনে আনতে বাধা দেয়। এটা ভাঙতে হবে। 

সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খানের মতে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এখন অনেক নারীই আসছেন। তবে দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিক বা     পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে নীতিনির্ধারণ বা প্রচলিত প্রথা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে না। নারীদেরকেই তার অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসতে হবে। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক সোমা দেব বলেন, অনেক নারী ইচ্ছে থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ পদে যেতে পারেন না বা তাকে যেতে দেওয়া হয় না। ফলে কষ্টে হতাশায় অনেক নারীই সাংবাদিকতা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যান। আবার যারা থেকে যান, তাদের যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হয় না বলে তারা খুবই হতাশায় ভোগেন। ফলে পলিসি মেকিং লেভেলে যাওয়ার মতো নারীদের যোগ্য ভাবা হয় না বা তারা পারবে না সেই ধারণাই বহাল থাকে। যে কারণে খুব কম নারীকেই আমরা নীতিনির্ধারণী পর্যায় পর্যন্ত যেতে দেখি। তবে যারা যেতে পারেন তাদের শত বাধা-বিঘ্ন, প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যেতে হয়। এজন্য যে পারিবারিক, সামাজিক সহযোগিতা দরকার, সেটা তারা বেশিরভাগ সময়ই পান না। যে কারণে ক্ষমতায়নের জায়গা থেকে নারীরা অনেক দূরে অবস্থান করে।

তবু আশার কথা, শত সমস্যাতেও এগিয়ে যেতে চায় নারীরা। প্রমাণ করতে চায় তার যোগ্যতা, দক্ষতা। 

নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েও তাই টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রিপোর্টিং ও বার্তা সম্পাদক হিসেবেও তাদের অংশগ্রহণ ইদানীং বাড়ছে। 

সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোতেও কেউ কেউ নির্বাচিত হচ্ছেন। তৃণমূলে নারী সাংবাদিকরা আসছেন সাহসের সঙ্গে এগিয়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃত্ব এবং পত্রিকার সম্পাদনাও করছেন। স্থানীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হচ্ছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ পরিচালনা ছাড়াও শিফট-ইন-চার্জ পদ দক্ষতার সঙ্গে সামলাচ্ছেন অনেক নারী। তবে তা উল্লেখযোগ্য নয়। 

সাংবাদিক নাসিমুন আরা মিনুর মতে, যখনই গণমাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে তখনই ‘জেন্ডার সংবেদনশীল’ পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব হবে। 

এ ক্ষেত্রে নারীর কর্মোপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য নীতি সংস্কার প্রয়োজন। পত্রিকা পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে অভ্যন্তরীণ পরিবেশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এর ফলে পুরুষতান্ত্রিক সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে সাংবাদিকতা জগতে নারীর অবস্থান দৃঢ়তর হবে। আর তখন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক হিসেবে নারীরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। 

বিশ্বব্যাপী চলছে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের কাজ। এসডিজি ৫-এর লক্ষ্য নারীদের সমান অধিকার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বা কোনো সহিংসতাসহ বৈষম্য ছাড়াই মুক্তভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ প্রদান করা। তবে এটা তখনই বাস্তবায়ন হবে যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। 

লেখক: সাংবাদিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //