পারিবারিক গল্পগুলোর মানে কী

আমার নানির বাবার পরিবারের আঞ্চলিক খ্যাতি ছিল বিত্তের কারণে। কিন্তু কী তাদের বিত্তের সূত্র, কী করে এত অঢেল সম্পত্তি ও ব্যবসার মালিক হলেন সেটা কেউ তেমন বলেন না। তারা দুই অঞ্চলে এক সঙ্গে বড়লোক ছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের হুগলী ও আসামের শিলং।

এক পা ছিল হুগলীর তাজপুর গ্রামে, যেখানে পরিবার থাকত। অন্যটি হচ্ছে শিলংয়ে, ১৯ শতকের মাঝামাঝিকালে বেশ দুর্গম এলাকা শিলং। সেখানেই তারা যান এই তাজপুর থেকে এবং গড়ে তোলেন তাদের তেজারতির প্রাণকেন্দ্র।

দুই

নানি তাদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে শিলং যান, তাদের একটু দূরের জনই ডিস্ট্রিক্টের হাটপুকুর গ্রামের আর এক পরিবারের সদস্য। আমি শুনেছি যে গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে সিলেট ডিঙিয়ে শিলং। তখন সেখানে বড় কোনো আবাসভূমি নেই। ইংরেজরা সবে প্রশাসনিক গোড়াপত্তন শুরু করেছে। তাদের কর্মীদের বহু কিছুর প্রয়োজন ছিল। তারা প্রস্তাব করে সাপ্লাই দেওয়ার। হাত মিলাও, থ্যাংক ইউ, কারবার শুরু, টাকা আনা যানাও শুরু।

তিন

যা শুনেছি তেজারতের মধ্যে ছিল দোকান মানে আড়তের সাইজের, বাড়িঘর ইত্যাদি। শতখানেক বাড়ি হবে শিলংয়ে। পেটেন্ট মেডিসিন বা প্রেসক্রিপশন ছাড়া জ্বরের ওষুধ ‘জ্বরের যম’, ঘোড়ার ডাক, এমনকি ব্যাংক, সবই ছিল খুব লাভবান। এতটাই যে তাদের আসামের যে মুসলমান এলিট সমাজ ছিল তার অন্যতম ভিত্তি বলা যায়। একসময় সেই দুই আদি সঙ্গীর পরিবারের এক মেয়ে আর এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। এর একজন আমার নানা, অন্যজন নানি।

চার

যে ধুমধাম করে বিয়ে হয় তার একটা উদাহরণ দেই যেটা নানির কাছে শোনা। ‘তাজপুর থেকে মিষ্টি পাঠানো হয় ১০ মাইল দূরের হাটপুকুরে। প্রথম মানুষটা যখন পৌঁছায় হাটপুকুর তখন শেষ মানুষটা ছাড়ছে তাজপুর। ৪ দিন মেলা বসে সবার জন্য সব ফ্রি।’ নানি অহংকার করে বললেও, এটা ছিল উপরি টাকা নষ্ট করা যেটা যুগে যুগে বিত্তবানেরা করে থাকে। কিন্তু এখানেই গল্পের মজাটা। আমার মা’র কথা দিয়ে শুরু করি।

পাঁচ

“তোমার বাবার সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হয় তখন এক ডাকাত দল ধরা পড়ে। তারা কোনো বিয়েবাড়িতে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিল। দারোগা তাদের জিজ্ঞাসা করে আমাদের বাড়ি কিনা। ডাকাত নেতা বলে, “উনাদের তো কোনো পয়সা নাই। মেয়ের বিয়ের জন্য তো মায়ের বাড়ির কাছ থেকে টাকা ধার করেছে। কী পাব এই বিয়েতে?” তবে আগের জৌলুস আর ছিল না কারও। কী কারণে এটা ঘটে জানি না, তবে একটা গল্প আছে ‘তাজপুর’ ওয়েবসাইটে কিছুটা, বাকিটা নানির কাছে শোনা। সেটা থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এবং এই গল্পের নায়ক একজন ‘জিন’। হ্যাঁ আগুনের তৈরি জিন। গল্পটা আমি ছোটবেলায় শুনি তাই আগে থেকেই জানতাম।

ছয়

মনে করা হতো, আমাদের বাড়িতে জিন থাকত এবং তার জন্যই নাকি আমাদের পরিবারের এত উন্নতি হয়। প্রতিদিন যখন খেতে বসত সবাই, তার জন্যও প্লেটে খাবার দেওয়া হতো, ভুল হতো না। কিন্তু একদিন ভুল হয়। নতুন কেউ টেবিল সাজায়। খেয়াল হয়নি কারও, ওনার জন্য প্লেট দেওয়া হয়নি। সবাই খেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির চিলেকোঠাতে, ছাদে তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। সবাই ছোটাছুটি করতে থাকে কিন্তু করার কিছু নেই। সবাই নাকি দেখে একটি অর্ধ-দৃশ্যমান চার ঘোড়ার জুড়ি গাড়িতে আলখেল্লা পরা এক মানুষ, চেহারায় ভীষণ রাগ, একটা সরু গলির মধ্যে তার বিশাল গাড়িসহ অদৃশ্য হয়ে যায়। তার কিছুদিন পর থেকে সব ব্যবসায় লোকসান হতে থাকে। সব বন্ধকে চলে যায়। 

সেই-ই নাকি ছিল আমাদের ভিত্তি, যখন চলে গেল, সব সঙ্গে নিয়ে গেছে।

সাত

খুব অদ্ভুত, উদ্ভট মনে হচ্ছে? আমার নানির পরিবারটা কিন্তু খুবই নামকরা। একজনের নাম কেউ কেউ শুনেও থাকতে পারেন। এস ওয়াজেদ আলী। সাহিত্যিক, কলকাতার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তার ছোট ভাই ডাক্তার ছিলেন, শরাফত আলী, বাংলাদেশ চলে আসেন, মিটফোর্ডের প্রধান ছিলেন। ছোটবেলায় তার একবার টাইফয়েড হয়, সারার কথা ছিল না। ডাক্তার প্রায় জবাব দিয়ে দেয়। কিন্তু তিনি হঠাৎ বলেন, “রাতে উনারা এসেছিলেন। হালুয়া খেতে দিয়ে গেছেন। বলেছেন দুই দিন পর জ্বর চলে যাবে।” সবাই প্রলাপ ভেবেছিল, কিন্তু আসলেই তাই হয়। এটাও আমার নানির কথা।

আট

তিনি খুব রাশভারী মানুষ ছিলেন, কথা কম বলতেন। কিন্তু আমাকে অনেক স্নেহ করতেন, বই দিতেন পড়তে। আমি তাই একদিন খুব সহজে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ’। অতএব কী ঘটেছিল?

নয়

কে বলবে কী ঘটেছিল? তবে গল্পটা মজার এবং সব যে কল্পনা তাও কি বলা যায়? টেবিলে প্লেটের বিষয়টি যদি গল্প হয় তাহলে ছোট নানার হালুয়া খাওয়া? অবশ্য আর্থ-সামাজিক কারণে ব্যবসার পতন পরিবারের পক্ষে হয়তো মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, তাই তারা বিকল্প কাহিনি বানায়। হয়তো যে ব্যবসা ছিল তার রমরমা দিন সবার জন্যই শেষ হয়, অথবা প্রতিযোগিতায় আঘাত করে। তবে ব্যবসা করে আর কেউ টিকে থাকতে পারেনি সেই কালের তারা।

দশ

যারা শিক্ষায় চলে যান তারা কেবল টিকে থাকেননি, ভালো আছে বা ছিলেনও। অত্যন্ত প্রসিদ্ধ তারা আজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলং পরিবারের ডাক্তার সদস্যরা সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশের জাতীয় পদক লাভ করেন। আর যারা ব্যবসা করতে চেয়েছেন যেমন আমার নানা, সব হারিয়ে ঢাকায় এসে ফতুর হয়ে মারা যান। তবে ইতিহাসের যা প্রয়োজন সেটাই কেবল টেকে।

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //