ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে অস্ত্র বেচবে কারা

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পর এবার ফিলিস্তিন-ইসরায়েল মুখোমুখি হয়েছে ৭ অক্টোবর সকালে ইসরায়েলের ওপর ফিলিস্তিনের হামলার মধ্য দিয়ে। ইসরায়েলের মিত্রদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাদের বন্ধুদেশগুলো নিয়ে এখন হয়তো অস্ত্র বিক্রির নতুন হিসাব কষছে। যুদ্ধ যত ছড়াবে তাদের অস্ত্রের বাজার ততই রমরমা হবে। এরই মধ্যে হামাসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। হামাসের হামলার পর গত শনিবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবশ্য বলেছিলেন, তারা যুদ্ধের মধ্যেই রয়েছেন। তবে সেটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছিল না। এর পর গাজায় সামরিক পদক্ষেপ নিতে নেতানিয়াহুকে অনুমোদন দেয় ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা।

মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় দুই ইসরায়েলি পর্যটককেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ কারণে মনে হচ্ছে যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। একই সঙ্গে হামাসের এই হামলাকে আমলে না নেওয়ার কোনো কারণ নেই। বিশ্বজুড়ে সামরিক শক্তির এত খ্যাতি, নিরাপত্তা ও নজরদারির সরঞ্জাম থাকার পরও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, শিন বেত ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর কেউই জানত না, হামাস এ ধরনের একটি হামলা করতে যাচ্ছে! কিংবা পেলেও হয়তো সেটা ঠেকানোর সুযোগ হয়নি। তবে এই ঘটনার পর ইসরায়েল হামলে পড়েছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতের জেরে হতাহতের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এসবের জেরে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নতুন করে বড় যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্য। 

ইসরায়েলের হামলায় গাজা এখন মৃত্যুপুরী। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে গাজার এক চিকিৎসক খামিস এলেসি বিবিসিকে বলেন, ‘গাজায় আপনি যেখানেই যাবেন, মৃত্যু দেখতে পাবেন, দেখবেন শেষকৃত্য চলছে। এটি এমন যেন আপনি একটি চলচ্চিত্র দেখছেন। চলচ্চিত্রটি মানুষের জীবনের সমাপ্তি নিয়ে। তবু এবার তাদের নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ সারা বিশে^র ইতিহাসে মার খাওয়া মানুষেরা একবার দাঁড়ানোর পথ পেলে তাদের ঠেকানো দুরূহ।’

শত শত রকেট দিয়ে ইসরায়েলের আয়রন নিরাপত্তা ব্যূহকে ভেদ করে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। প্যারাসুট নিয়ে হামাস সদস্যরা ইসরায়েলে প্রবেশ করে এবং হামলা চালায়। ফিলিস্তিনের হতবাক করা হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে ইসরায়েলের আত্মবিশ্বাস। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের নাগরিকদের যে আস্থা ছিল, তাতেও ভয়ঙ্করভাবে চিড় ধরেছে। ফিলিস্তিনিদের এই হামলা চমকে দেওয়ার মতোই।

বর্ষীয়ান ইসরায়েলি রাজনৈতিক ভাষ্যকার মেরন র‌্যাপোপোর্ট মিডল ইস্ট আইকে বলছিলেন, ‘ইসরায়েল হতোদ্যম, নিজ ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ আর ইসরায়েলের হাতে নেই। ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে গাজা উপত্যকার আশপাশে নজরদারির জন্য শৌখিন ও বহুমূল্য অবকাঠামো গড়ে তুলেছিল। এই অঞ্চলকে ২০০৭ সালে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। সেখানে ক্যামেরা ও আকাশে ড্রোন ওড়ার কথা। এই বেষ্টনী অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব। ফলে ইসরায়েলের যে প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি, তাতে এই আঘাত অকল্পনীয়।’

দুই দেশ নিজেদের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে একটি সমঝোতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যস্থতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর যুুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা তো বানরের পিঠাভাগের মতো, এটা সবারই জানা। বিশেষত মধ্যস্থতাকারী মোড়ল দেশটি এই হামলার পর বলেছে, ইসরায়েল তার আত্মরক্ষার জন্য যেটা প্রয়োজন করতে পারে। তাতে মার্কিন জোটের অস্ত্র বিক্রির একটা পথ খুলে যায়। আমরা মনে করতে পারি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধিয়ে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো যেভাবে অস্ত্রের করবার করছে; তাতে যুদ্ধ বন্ধের কোনো লক্ষণ নেই। 

গাজা উপত্যকা ঘিরে হাজার হাজার সেনা মোতায়েনের খবরও জানিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলি বাহিনীর এক মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা হামাসের ওপর তীব্র হামলা চালাতে যাচ্ছি।’ গত রবিবার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলের দখল করা শেবা ফার্ম এলাকায় রকেট ও কামান হামলা চালায় হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা চাই না হিজবুল্লাহ এই সংঘাতে জড়াক।’ 

ইসরায়েল যুদ্ধ ঘোষণা করায় ইতোমধ্যে হিজবুল্লাহ হামলা চালিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ব্রাদারহুডসহ বিভিন্ন ইসলামি গ্রুপ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে। তাতে অস্ত্রবাজার বড় হবে। ‘কারও ঘর পোড়ে কেউ আলু পোড়া খায়’- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের এই গ্রামীণ প্রবচনটি একদম সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অন্যরূপ। 

আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলো এই হামলার নিন্দা করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে একটি প্রশ্ন জরুরি। যারা এই হামলার নিন্দা করেছে তারা ইসরাইল যখন শত শত ফিলিস্তিনিকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে তখন এই নিন্দা জানান না কেন? তাদের মানবাধিকার তখন কোথায় থাকে? তবে একই সঙ্গে এ কথাও ঠিক যে হামাসের এই আক্রমণের পর ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনিদের দেখছে এটা একদম নতুন। দুই পক্ষই শান্তির পথে না আসলে ভোগান্তি হবে সাধারণ জনগণের। ইতোমধ্যে জনগণের ভেতরে ভয় ঢুকেছে। তারা কেউ পালাচ্ছে, কেউবা খাবার মজুদ করছে। এ অবস্থায় দুপক্ষের আলোচনায় বসা জরুরি। শত বছরের এই ক্ষত কেন সারিয়ে তোলা হচ্ছে না, সেটা বড় প্রশ্ন। ফিলিস্তিনিরা কি যুগের পর যুগ যুদ্ধ করে যাবে? আর জাতিসংঘ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে সব দেখলে তাদের প্রয়োজনীয়তা কোথায়?

লেখক: সাংবাদিক ও  গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //