হাউসওয়াইফ এখনো থ্যাংকলেস জব

কয়েক দিন থেকেই ভাবছিলাম যারা কেবলই গৃহিণী তাদের কথা। পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, ভূমিকার কথা ভাবতে ভাবতে অনুভব করলাম পরিবারের অন্যান্য সদস্যের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে তাদের অপরিসীম ত্যাগ। অথচ এখনো সে যদি কর্মজীবী না হয়ে কেবলই গৃহিণী হয়ে থাকেন, গৃহস্বামীদের বলতে শুনি ‘সে তো কিছু করে না।’ অথচ তাদের ভূমিকার কথা তারা একটুও ভাবেন না। কিছু কিছু গৃহস্বামী নিশ্চয়ই ঘরের কাজে গৃহিণীদের সময় দেন, কিন্তু সেটা কদাচিৎ। এই গৃহিণীদের কাজের কোনো সময়রেখা নেই। তারা চব্বিশ ঘণ্টাই নিয়োজিত ঘরের জন্য। অথচ যারা চাকরি করেন, তাদের শ্রমসময় ৮ ঘণ্টা। নারীবাদীরাও এই ত্যাগী গৃহিণীদের ভূমিকা নিয়ে কখনো তেমন কিছু বলেছে বলে স্মরণে আসছে না। এই গৃহিণীদের কাজ এখনো ‘থ্যাংকলেস’।

যারা হাউস ওয়াইফ বা গৃহিণী তাদের কাছে কর্মজীবী মানুষের অনেক ঋণ। কিন্তু এই ঋণ অনেকেই স্বীকার করতে চান না। এই মা বোনেরা ঘরে কত রকম কাজ যে করে তা অফিসে কাজ করা মানুষেরা বুঝতে চান না। অফিসের মানুষদের কাজের টাইম ফ্রেম থাকে, কিন্তু ঘরের মানুষদের তা থাকে না। ঘুম থেকে উঠে শুরু হয় কাজ, শেষ হয় ঘুমোতে যাওয়ার আগে। সকালবেলা নাশতা বানানো, অফিসের মানুষদের রেডি করা, সন্তান সামলানো, তাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসা, ঘর গোছানো, দুপুরের খাবার রেডি করা, বিকালে অফিস থেকে ফেরা স্বামীর জন্য চা নাশতা রেডি করা, মেহমান সামলানো, রাতের খাবারের আয়োজন, সবার সঙ্গে হাসিমুখে মানিয়ে চলা। তার পরও তাদের প্রতি কত অভিযোগ। আমার মা-বোনকে দেখেছি গনগনে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘেমে কাজ করতে। আহা এদের নিজের দিকে তাকানোর সময় নেই যেন। ঘরের পুরুষদের উচিত ছুটির দিনে ঘরের কাজের পুরো দায়িত্ব নেওয়া, তাহলে বুঝত এই কাজের মূল্য।

কেন বললাম এই কথাগুলো! কারণ আমি ঘরের সব কাজ করি। যখন একা ছিলাম তখনো করেছি, সংসারে থাকা অবস্থায়ও করেছি, এখন আবার একা আছি, করছি। সিম্পল এক কাপ চা বানাতে গেলে বুঝবেন কতগুলো আয়োজনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। চুলায় পানি বসাতে হয়, পানি গরম হলে পরিমাণমতো লিকার এবং অন্যান্য উপকরণ দিতে হয়। কাপ ধুতে হয়। চা খাওয়া শেষ হলে চায়ের পাতিল পরিষ্কার করতে হয়, কাপ পরিষ্কার করতে হয়, সিঙ্ক পরিষ্কার করতে হয়। আরও কত কী।

এ তো গেল শহুরে গৃহিণীদের কথা। আমি গৃহস্থ পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। সেখানে পুরুষের চাইতে নারীর ভূমিকা অনেক। পুরুষ ফসল কেটে ঘরের উঠোন পর্যন্ত আনছে। তারপর সেটাকে কতগুলো ধাপ পেরিয়ে তারপর ব্যবহার উপযোগী করে পুরুষের সামনে উপস্থাপন করছে গৃহিণী। ধান, গম, যব, ছোলা, পাট, খেসারি, মসুর, সবজি, ফলমূল এসব উৎপাদনে গৃহিণীর ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। ঘরের সন্তান এবং গবাদি পশুদের সমান্তরালে যত্ন নেন তারা। পুরুষরা যখন সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে বসে আড্ডাবাজি করেন, গৃহিণীরা তখন চুলার আগুনের সামনে পরিবারের সদস্যদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করেন। কোনো কোনো গৃহস্বামী তো খাবারের পর নিজের প্লেটটাও না ধুয়ে উঠে পড়েন, জগ থেকে গ্লাসে পানিটাও নিজে ঢেলে খেতে পারেন না।

আমি পুরুষের ভূমিকাকে কস্মিনকালেও ছোট করে দেখছি না। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে অফিস আদালতে কাজ করছে বহুদিন থেকেই। সেসব নিয়েও আমার কোনো কথা নেই। শুধু এই গৃহিণীদের কাজটাকে একটা বড় ‘কর্ম’ এই স্বীকৃতিটা দেওয়া উচিত। এই গৃহিণীরা কাজ না করলে আপনাদের বাবুগিরি কই যেত। কাজেই অনুভব করুন তাদের। পাশে দাঁড়ান ভালোবাসা নিয়ে, সম্মান করুন। আর হাত গুটিয়ে বসে না থেকে সময় পেলে তাদের কাজে একটু সহযোগিতা করুন। কাজটি কিন্তু শুধু তার নয়, আপনারও।

লেখক: কবি, অভিনেতা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //