একটি ওয়েবনিয়া আলোচনা শিরোনাম ও একটি প্রবাদ

বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া সকালে অনলাইনে ২/৩টা পত্রিকার শিরোনাম দেখে নেওয়া বরাবরের অভ্যাস। ২ অক্টোবর সোমবার সকালে পত্রিকা খুলতেই একটি সাব-হেডিংয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। তাতে লেখা ‘অতীতে বিদেশিদের তৎপরতায় লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ’। পরে অনলাইনে আরও একটি পত্রিকায় একই রকম শিরোনাম দেখে তো তাজ্জব! 

অনলাইনে এখন প্রায়শই নানা আলোচনা হয়। সবটা খবরপত্রে আসে না। কিন্তু তথ্য পরিবেশন ও বিশ্লেষণ-পর্যালোচনার মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। তাদের লেখা বা বক্তৃতায় যদি কোনো তথ্য একপেশে, খণ্ডিত বা ভুল থাকে, তবে তা যথার্থ নয়। প্রতিবেদনের হেডিং বা পরিবেশনে হলেও তা সমান ক্ষতিকর। পাঠকদের ভুল বার্তা দিয়ে মনোজগৎকে প্রভাবিত করা সংবাদপত্রসেবীদের কাজ নয়। 

রাজনৈতিক দলের লোভী-দুর্নীতিবাজরা বাস্তব জগতে লুটপাট করে সমাজ-রাজনীতির ক্ষতি করে, এতে বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষকরা উচ্চকণ্ঠ হবেন এটাই কাম্য। কিন্তু ভুল তথ্য পরিবেশন করলে পাঠক ও জনগণের মনোজগৎ কি লুট হয় না? বাস্তব জগৎ ও মনোজগৎকে নিয়েই গড়ে ওঠে রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি। তাই এমনটা বলাই যায়, দুটোই গর্হিত অপরাধ।

এখানে আরও একটি কথা প্রাসঙ্গিক। আমার মতো যারা সরাসরি রাজনৈতিক দল ও লেখালেখি করেন, তাদেরও কিন্তু একপেশে, খণ্ডিত, ভুল তথ্য পরিবেশন অপরাধ। তবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের অধিকার রাখেন নিজ দলের মত সামনে আনতে। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে যদি তা করা হয়, একে কী বলা যাবে! আরও একটি বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলে এমন মানুষ বহু আছেন, যারা নিজ দল ক্ষমতায় থাকুক সেটা যেমন চায়, তেমনি রাজনীতি শহীদদের রক্তস্নাত জন্মলগ্নের মর্মবাণী, যা বাহাত্তরের সংবিধানে জাতীয় চার নীতির ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে, এর বাস্তবায়ন চায়। অর্থাৎ দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার বিষয়টাও কেবল সুশীল সমাজই নয়, রাজনীতিকরাও গুরুত্ব দেয়।

কথাটা বলা হলো এজন্য যে, দেশের নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী সমাজ (হালে বলা হয় সুশীল সমাজ বিবেকের ভূমিকা নেবেন, এমনটাই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কাম্য। পাকিস্তানি আমলে বুদ্ধিজীবী, যারা ছিলেন বিবেকের ভূমিকায়, তাদের দেখে ও কথাবার্তা শুনে দল-মত নির্বিশেষে মানুষ শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যেত। ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে তাদের খুব সামনে থেকে দেখেছি, আলাপচারিতায় অভিভূত হয়ে যেতাম।

যাত্রায় সাধারণভাবে বিবেক সত্যভাবে অতীত-বর্তমান তুলে ধরেন, ভবিষ্যদ্বাণী করেন। রাজা-রাজন্যবর্গ সত্য-মিথ্যার তোয়াক্কা করেন না। ফলে পরিণতি হয় বিয়োগান্তক। আমাদের জাতির সৌভাগ্য এই যে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজনীতিক ও জাতির বিবেক হিসেবে বুদ্ধিজীবীরা একই মোহনায় মিলিত হয়েছিলেন। এমনটা হয়েছিল গণজাগরণ-গণঅভ্যুত্থান-গণযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তাতেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা এসেছিল।

কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিক আর সুশীল সমাজের মধ্যে কেবল ফারাকই বাড়ছে। ‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ প্রবাদটা ক্রমে যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দল ক্ষমতা রাখতে বা যেতে মরিয়া হবে, এমনটাই স্বাভাবিক। ‘সূচ্যগ্র মেদেনী ছাড় না দেওয়া’ কিংবা শঠে শঠাং বহুকাল আগে থেকেই রাজনীতির ধর্ম। কিন্তু সুশীল সমাজ এতটাই রাজনীতি করছেন যে, বিবেকের ভূমিকা তারা নিতে পারছেন না। ক্রমেই বেশি দলীয় হয়ে যাচ্ছেন। 

রাজনীতির ইতিহাসে এমনটা স্বতঃসিদ্ধ, যার যা ভূমিকা, সেই ভূমিকার বাইরে গেলেই বিপদ অনিবার্য। দেশের রাজনীতিতে অন্তত ষাট বছরের পরিক্রমা করেছি বলে জানি, পাকিস্তানে আর্মিরা রাজনীতিকদের উদ্দেশে বলতে ভালোবাসতেন ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’। আইয়ুব-ইয়াহিয়া এই চিন্তায় সফল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন, তখন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাওয়ার সুবাদে জানি, তাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন।

গ্রাম-গঞ্জে একটা কথা আছে, চিন্তা অর্ধেক আর কাজ অর্ধেক। অর্থাৎ চিন্তা করলেই কাজ অর্ধেক হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চিন্তাই ক্রমে প্রসারিত হতে হতে পঁচাত্তরের রক্তাক্ত ঘটনার জন্ম দেয়। রক্তাক্ত পটপরিবর্তনে পাকিস্তানের মতোই আর্মি ক্ষমতায় আসে। মুক্তিযুদ্ধ যেমন ছিল জাতির মাহেন্দ্রক্ষণ, পঁচাত্তর তেমনি জাতিবিরোধী শক্তির মাহেন্দ্রক্ষণ। ইতিহাসের গতিধারায় একবিংশ শতকের শুরুতে এসে সুশীল সমাজের নিরপেক্ষ অংশও মনে করতে থাকে, রাজনীতিকদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। এরই পরিণতি আর্মি-সুশীল মিলে জরুরি আইনের শাসন। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা ও ইউনূসের নেতৃত্বে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের তোড়জোড় হচ্ছে তারই ফসল।

এসবই হয়েছিল সুশাসন তথা সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা-জবাবদাহিতা-আইনের শাসন-মানবাধিকারের নামে। সুশাসন কি দিতে পেরেছিল ওই সরকার? ইতিহাসবিস্মৃত জাতি আমরা। যে দেশে সুশীল সমাজ বিস্মৃত কিংবা ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেন, সেই জাতির তো এমনটা হবেই। দুই নেত্রীকে অন্তরীণ করার যুক্তি উত্থাপন করা হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। কী হয়েছিল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠে? দ্রব্যমূল্যের পারদ কোথায় উঠেছিল? মুক্তবুদ্ধির চর্চা? দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি! অনেকের বিবেচনায় তেমন গর্হিত কিছু না হলেও তো মাফ চাইতে হয়েছিল। 

বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করেছে, আর্মির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসন কিংবা আর্মি-সুশীল শাসন রাজনৈতিক দলের শাসনের কোনো বিকল্প নয়। বরং হিতে বিপরীত হয়। রাজনীতিকে রাজনীতির মতোই অগ্রসর করতে যেমন দিতে হবে, তেমনি সুশীল সমাজকেও বিবেকের ভূমিকায় থাকতে হবে। ইউরোপে গণতন্ত্র শুরু হওয়ার পর দশকের পর দশক গেছে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে। আমেরিকান জাতি বর্বরতা দিয়ে ‘ফার্স্ট ন্যাশনস পিপল’কে চরম নির্যাতন-ভূমি থেকে বিতাড়ন এবং নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ করে যে জাতি গড়ে তুলেছে, সেই জাতির শিকড়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও অতীতের পিছুটান না থাকায় সময় কম লেগেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মনে হচ্ছে, সেখানেও অসহিষ্ণুতার তাপ অনুভূত।

প্রাসঙ্গিক কথা থেকে আসল কথা অর্থাৎ হেডিং দেখে প্রতিক্রিয়া কেন হয়েছিল বলি। ‘অতীতে বিদেশিদের তৎপরতায় লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ’ বাক্য আসলে তথ্যের কষ্টিপাথরে ভ্রান্ত। হেডিং দেখে বোঝার উপায় নেই অতীতের ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ ১৯৯৬, ২০০৬, ২০১৩ সালের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কথাটা বলেছেন। প্রথম দুটো সালের আন্দোলনে বিএনপি পরাজিত হয়েছে। বিদেশিদের নাক গলানো অনুঘটক হিসেবে কতটুকু নিষ্পত্তিমূলক ছিল তা নিয়ে বিতর্ক করা এবং দ্বিমত হওয়ারও অবকাশ আছে।

কিন্তু যারা কেবল হেডিং পড়েন, পুরো সংবাদ পড়েন না বা পড়ার সময় পান না, তাদের মনোজগৎ এই শিরোনাম কী ছাপ ফেলবে! যদি শিরোনামে ‘সাম্প্রতিক’ বা অন্য কোনো প্রযোজ্য শব্দ যুক্ত করা হতো তবে তো তথ্যের সঙ্গে অনেকটাই জুতসই হতো। তাই বলা যায়, যেসব সংবাদপত্র এই শিরোনাম সামনে এনেছে, সেই পত্রিকা পাঠকদের মনোজগৎকে প্রভাবিত করতে একপেশে, খণ্ডিত ও ভুল বার্তা দিতে চেয়েছেন। দেবতাবিশেষে তৃতীয় নয়ন থাকে এবং সেই তৃতীয় নয়ন অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যতের সত্য দ্রষ্টা। পত্রিকা মাত্রই তৃতীয় নয়ন বলা হয়। আসলে কী হচ্ছে? এখানেও পত্রিকাগুলো কিন্তু ‘বন্যরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ প্রবাদের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছেন। সুন্দর মলিন হয়ে যাচ্ছে।

এখন আসা যাক, বিশিষ্ট বিদেশি অধ্যাপক ও বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজের কথায়। বঙ্গবন্ধুর আমলে অনুষ্ঠিত প্রথম সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে যে ভোট হয়, সেই ভোট এবং পূর্বে সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে বিদেশিরা নাক গলিয়েছিল বলে অভিযোগ কখনো তোলা হয়নি এবং তেমন কোনো তথ্যও নেই। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যার নায়ক মোশতাক হচ্ছেন বিদেশিদের নাক গলানোর প্রথম বেনিফিশিয়ারি। সেনাশাসক জিয়া ও এরশাদের সময়কালে বিদেশিদের নাক কোন ব্যক্তি ও দলের দিকে গলানো ছিল, তা অনলাইনে তখনকার পত্রিকা পড়লেই জানা যাবে।

ক্যু-পাল্টা ক্যুয়ের সময় নির্বিচারে সেনা-হত্যা এবং এরশাদ আমলে সেলিম-দেলওয়ার-তাজুল-ময়েজউদ্দিন হত্যার দিনগুলোতে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের বিষয় যখন লুণ্ঠিত, তখন বিদেশিদের নাক কি সর্দি লেগে বন্ধ ছিল? ১৯৯১, ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি ও ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় কার পক্ষে ছিল নাক! তথ্য সাজিয়ে সব এ ক্ষুদ্র কলামে বলা যাবে না। বর্তমানে আমাদের মতো ছোট দেশগুলোতে ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক- সামরিক কারণে বিদেশিদের নাক গলানো ক্রমেই বাড়ছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণে সুস্পষ্ট, এমনটা যতটুকু বাড়ে অভ্যন্তরীণ কারণে তার চাইতে উপরোল্লেখিত কারণে আরও বাড়ছে।

অধ্যাপক রীয়াজ কেবল তিনটি সময়কে এনে এভাবে তথ্যকে খণ্ডিতভাবে না উত্থাপন করলেই ভালো করতেন। বিদেশে থেকেও তিনি যদি নিজ দেশে বিবেকের ভূমিকা পালন করতে চান, তবে তথ্য যথাযথভাবে উপস্থাপিত করা প্রয়োজন। তবে পর্যালোচনা বিশ্লেষণ তিনি তার মতো করতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি যদি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে অবস্থান নেন, তাতে বিবেক না হলেও অন্তত রাজনৈতিক পক্ষভুক্ত বুদ্ধিজীবী হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো দলের কাছে সমাদৃত হবেন।

-কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //