বঙ্গবন্ধুকে নয়, ঘাতকরা হত্যা করতে চেয়েছিল তার আদর্শকে

বঙ্গবন্ধু ও তার গোটা পরিবারকে সমূলে নিঃশেষ করে দেওয়ার চক্রান্তের ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় যা সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেই নির্মম খবর প্রচারিত হয়েছিল দিনের আলো ফুটে উঠতে না উঠতেই ইথারে ইথারে। ভাষাশূন্য বধির সময়টাকে কে কীভাবে ধারণ করেছিল সে ইতিহাস অন্য অধ্যায়।

“আমার ঘোষিত এই অধ্যাদেশ অথবা সামরিক আইনবিধি অথবা আদেশ সম্পর্কে অথবা নির্দেশ অনুযায়ী কৃত কোনো কাজ বা নেওয়া কোনো ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অধিকার সুপ্রিমকোর্ট, ট্রাইব্যুনাল অথবা কোনো কর্তৃপক্ষসহ কোনো আদালতেরই থাকিবে না।” খন্দকার মোশতাক কর্তৃক ‘অসাধারণ’ সামরিক ফরমান বাংলাদেশ গেজেট, রেজি নং উঅ-১, ২০ আগস্ট ১৯৭৫, ঘোষিত হয়েছিল ঘটনার ঠিক ৫ দিন পর। সেই রক্তাক্ত ঘটনার পর এমন একটি ঘোষণা সরকারিভাবে যখন প্রচারিত হলো, বাঙালি জাতি যেন সত্যিকারভাবেই অতল অন্ধকারে ছিটকে পড়ল। কারণ পৃথিবীতে যে কোনো হত্যাকাণ্ড অপরাধ সপ্রণোদিত হয়ে বিচারের দরজা বন্ধ করে দেওয়াও যে তার চাইতে বড় অপরাধ, এই বাংলার মাটিতে সেটাই হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল সে সময়ের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালে। ২৩ সেপ্টেম্বর এই ইনডেমনিটি অর্থাৎ দায় মুক্তি আদেশ জারি করা হয়।

রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের পর কেটে গেছে খন্দকার মোশতাকের ৮০ দিনের রাজত্বকাল। কেটেছে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার একটানা ২১ বছরের শাসনামল। সেই কালো অধ্যাদেশ বহাল ছিল পুরো সময় জুড়ে। বাংলাদেশের কোনো আদালতে স্বাধীনতার স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া তো দূরের কথা, এমনকি এই ঘটনা সম্পর্কিত কোনো প্রশ্নই তোলা যায়নি এই অধ্যাদেশের দৌলতে।

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না- সেটা বারবার প্রমাণ হচ্ছে। সেই রক্তাক্ত কালরাত্রির ভয়াল থাবা থেকে বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। শোকসন্তপ্ত শেখ হাসিনা দেশে ফিরে একদিকে স্বজন হারানোর বেদনায় ছিলেন মুহ্যমান, অন্যদিকে অভিভাবক হয়ে দাঁড়ালেন যারা বিচ্ছিন্ন ও ভীত হয়ে পড়েছিলেন শাসকের রক্তচক্ষু দেখে, শক্ত হাতে ভেঙে পড়া আওয়ামী লীগ দলটিকে পরিচালনা করতে লাগলেন। সাহস জুগিয়ে সংগঠিত করতে লাগলেন দলের নেতা-কর্মীদের। স্পার্টাকাসের সাহস নিয়ে তিনি লড়ে যেতে লাগলেন দানবদের সঙ্গে বারবার সাক্ষাৎ মৃত্যুকে পরাজিত করে। শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনের মাধম্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় এলো। এরপর ১৯৯৭ সালে ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট ইনডেমনিটি আইন বাতিল ঘোষণ করে। অতঃপর প্রচলিত আইনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়।

এরপর খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা, দীর্ঘ শুনানি, জেরা ও উভয় পক্ষের আইনজীবীদের সওয়াল-জবাব শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারিক আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলার রায় ঘোষণা করে। মাননীয় আদালত আত্মস্বীকৃত ১৫ খুনিকে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। জাতি মুক্ত হলো ঘৃণ্য কলঙ্ক থেকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক ঐতিহাসিক দিন।

বঙ্গবন্ধু এমন এক ব্যক্তিত্ব, ছিলেন এমন এক হৃদয়ের অধিকারী, যেখানে দেখতে পাই নির্মল উদার এক আকাশ, যা বাংলাদেশের সাধারণ থেকে অতিসাধারণ মানুষের মাথার উপর বিরাজ করত ছায়ার মতো।

সেই অবিসংবাদিত নেতাকে জীবন দিতে হলো বিশ্বাসের চরম মূল্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক ও সচেতন থাকার কথা বলা হলেও নিজেকে তার প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশকে অনিরাপদ ভাবার সংকীর্ণতায় তিনি মুহূর্তের জন্য ভোগেননি।

সেই সঙ্গে সেদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে খুনিরা চেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনসমূহ এবং বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী আদর্শকে হত্যা করতে। হত্যা করতে চেয়েছিল ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণীত স্বাধীন বাংলার চার স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে- যা ছিল বাংলাদেশ পরিচালনার মূলনীতি।

যে নেতা সারা জীবন ছিলেন অসাধ্য সাধনের রাজনৈতিক ব্রতে নিয়োজিত, যার সামনে কণ্টকাকীর্ণ পথ ছিল বিস্তৃত, যিনি দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, জেল-জুলুম, নির্যাতন, পাকিস্তানিদের খুঁড়ে-রাখা কবরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর হুমকিকে উপেক্ষা করে দীপ্ত কণ্ঠে বলেছেন বাংলার স্বাধীনতার কথা; গোটা নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের সময়টা যার অমিত কণ্ঠস্বর নেতৃত্ব দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের, একটি ভূখণ্ডকে বাঙালির চিন্তা চেতনাকে মূর্ত করে তুলেছে, পত্তন করেছে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের। এখানেই তার নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা। এই স্বদেশকে প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়াই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য। তিনি হুংকার তুলেছিলেন সকল প্রকার দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে, ভূমিকা নিয়েছিলেন অমিত অক্লান্ত এক যোদ্ধার। সে পথে দেশ-বিদেশের প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বার্থান্বেষীদের বাধা ছিল।

সেই বাধাকে অতিক্রম করতে করতেই তিনি জীবন দিলেন। পাকিস্তানি হানাদারদের নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।’ সেই রক্তের শেষ ঋণ তিনি শোধ করেছিলেন নিজের রক্ত ঢেলে। তিনি সকল ঝড়-ঝঞ্ঝা, দুঃখ দৈন্যের মধ্যেও তার সদাজাগ্রত প্রাণময়বাণী জাতির জীবনে যে শিহরণ জাগিয়েছিলেন, তা সেদিন যেমন ছিল, আজও প্রকৃত বাঙালিকে জাগিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। 

প্রকৃত সন্ন্যাসীর পরিচয় গেরুয়াতে নয়, বৈরাগ্যেই তার পরিচয়। বাইরের লেবাস নয়, বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও চেতনা আমাদের ভেতরের বস্তু হয়ে উঠুক, তবেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা সার্থক হয়ে উঠবে এটাই হোক আমাদের আজকের শপথ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //