নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধে বই

রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে আজ অবক্ষয় দৃশ্যমান। বস্তুত মূল্যবোধের অবক্ষয় এত ব্যাপক যে, বিষয়টি দিন দিন আলোচনার ক্ষেত্র অবারিত করে তুলেছে। একজন অভিভাবক আক্ষেপ করেন, ‘আমাদের ছেলেবেলায় পথে-ঘাটে যেখানেই হোক সিনিয়র কাউকে দেখলে বিনয়ের সঙ্গে সালাম বা অভিবাদন দিতাম, আর আজকাল একজন কিশোর যখন ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে রাস্তায় ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে হেঁটে যায়, তখন নিজেকেই মুখ লুকোতে হয়। এমন দিন তো ছিল না।’

বলাবাহুল্য এই খেদোক্তি জেনারেশন গ্যাপ বলা যেতে পারে, কিন্তু অবক্ষয়ের সার্বিক বিষয় এড়িয়ে যাওয়া দুষ্কর। 

সমাজ গঠিত হওয়ার পর থেকে যেসব নিয়মকানুন সবার জন্য মঙ্গলজনক ও অনুসরণীয় সেসবের সমষ্টিই নৈতিক মূল্যবোধ। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চমৎকার একটি উক্তি করেছেন। তার মতে, ‘নৈতিকতা হলো সে-সকল আদর্শ ও নীতি যার মাধ্যমে মানুষ তার ব্যক্তিজীবন পরিচালনা করে থাকেন।’ এখানে উল্লেখ করা অতিশয়োক্তি হবে না যে, নৈতিকতা ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে ধাবিত হয়। সুতরাং একেক ধর্মে নৈতিকতার স্বরূপ পৃথক পৃথক হলেও মানবতাবাদ হলো সবচেয়ে মূল্যবান। অনৈতিকতার রূপ বদলাতে পারে, নিষ্ঠুর হতে পারে, কিন্তু নৈতিকতার রূপ শাশ্বত সুন্দর ও চিরন্তন। এখানে প্রথম শর্ত হলো মানবতা। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। 

সমাজে একজন ব্যক্তি যেসব আচরণ অনুসরণ করে থাকেন, সমাজ ঠিক তেমন আচরণই ফিরিয়ে দেয়। সুতরাং একটি সমাজের নৈতিকতার অবস্থান উল্লিখিত সমাজে বসবাসরত মানুষের পারস্পরিক আচরণের দিকে লক্ষ করলে সহজেই বোঝা যায়। আমরা ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলেও এর সত্যতা দেখতে পাই। আজ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক সহাবস্থানের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বন্ধুসুলভ সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আদান-প্রদান, নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ইত্যাদির মাধ্যমে কাছাকাছি এসেছে। তারপরও মানুষ নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন এলাকা ও তার পরিমণ্ডলে অনুসরিত নৈতিকতার গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। একটি জাতির নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তার জন্য সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ এবং অন্যভাবে বলা যায় যে, সামাজিক বিশৃঙ্খলার পরিণতি মূল্যবোধের অবক্ষয়। এ যেন ঠিক শাঁখের করাতের মতো।

আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কখন শুরু হয়েছে, সেটি গবেষকগণের থিসিসের বিষয় হতে পারে; কিন্তু চলমান বাস্তব অবস্থা কাক্সিক্ষত নয়। এখানে ‘ভালো কাজের পুরস্কার আর মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার’ বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত বিবিধ অপরাধপ্রবণতার আগ্রাসন, তুচ্ছ ঘটনার কারণে মারামারি, এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। একজন আরেকজনকে প্রতারিত করছে। কিশোরদের মধ্যে ছোঁ-পার্টি, মলমপার্টি, চুরি-ছিনতাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি একজন ছাত্রকে একই স্কুলের সহপাঠী ও অন্যান্য ছাত্র মিলে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে হত্যা করেছে। উদ্দেশ্য নিহত ছাত্রের পিতার নিকট থেকে মুক্তিপণ আদায়। অন্য একটি ঘটনায় দেখা যায়, একজন পিতা তার স্ত্রী-কন্যা-পুত্রকে হত্যার পর থানায় আত্মসমর্পণ করে এবং বিচারে আদালত যখন তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় পড়ে শোনায়, অপরাধী পিতা কাঠগড়াতেই সেজদা দিয়েছে। বস্তুত সমাজে প্রতিদিন এ রকম শত শত ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো সংবাদপত্র তো বটেই, টিভির পর্দায় নিউজ আপডেট শিরোনামের স্ক্রলিংয়েও এমন খবরাখবর দেখে দেখে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এ দেশেই একসময় ‘গোয়েন্দা পত্রিকা’ নামক রহস্য-রোমাঞ্চের জনপ্রিয় একটি পত্রিকার ফ্ল্যাপে সতর্কবার্তা লেখা থাকত ‘দুর্বলচিত্তের ব্যক্তিদের জন্য এই পত্রিকা নয়’। এটি ব্যবসা কৌশল অথবা অন্য যে কারণেই হোক না কেন, মানসিক সুস্থিরতা বিনষ্টকারী এসব খবর টিভিতে প্রচার করা হয় কেন, যেখানে সকল বয়সের মানুষ টিভি দেখেন। এটি নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সরের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব কি তবে মূল্যবোধের অবক্ষয় বিবেচনায় আনা যাবে না? অবশ্যই এসব হলো নৈতিকতা বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিরূপ। 

আমাদের সমাজব্যবস্থা আবহমানকালের নিজস্ব সংস্কৃতি ও অনুশাসনের মধ্যে বিকশিত হয়েছে। গুরুজনদের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ-আদর, অতিথিদের আপ্যায়ন ইত্যাদি আচার-আচরণ এ সমাজেরই আদর্শ নীতি এবং ইতিবাচক শিষ্টাচার। যৌথ পরিবার ব্যবস্থা যুগের ও কর্মের প্রয়োজনে ভিন্নরূপ ধারণ করলেও বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাপনের ঐতিহ্যগত অংশ এই আচরণগুলো আজও কোথাও কোথাও চমৎকারভাবে অনুসরণ করা হয়। 

একসময় একেকটি বাড়িতে শিশুদের মানসিক বিকাশ ও চিন্তার উৎকর্ষের জন্য, এমনকি নিজেদের জন্যও বইপড়ার অভ্যাস ছিল। আলমারির মধ্যে দেখা যেত রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, নজরুলের সঞ্চিতাসহ মূল্যবান বইয়ের সংগ্রহ। পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে ছিল শিশু-কিশোর-যুবা সকল বয়সীদের মনোযোগী অধ্যয়ন। এখন বেশিরভাগ লাইব্রেরি বিলুপ্তপ্রায় সিনেমাহলগুলোর মতো নির্জন একাকী হয়ে গেছে। পাঠক নেই। যদিও-বা কোথাও দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগই সংবাদপত্র পাঠক, সেখানে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি অতিনগণ্য কিংবা শূন্য। অথচ প্রতিবছর শত শত শিশুতোষ বা শিশু-কিশোর উপযোগী বই প্রকাশ পাচ্ছে। কী আছে সেই বইয়ে? শিশু-কিশোর তো বটেই, পিতামাতা অভিভাবকদেরও সময় আর আগ্রহ নেই সেটি একপলক দেখার।

ফলে একদিকে অজানাকে জানা, নৈতিক শিক্ষা, চরিত্রগঠন, দেশপ্রেম, মানবসেবা ইত্যাদি সবকিছু উপেক্ষিত হয়ে চলেছে। সমাজের বিদগ্ধ ব্যক্তিগণ স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বই উপহার দেওয়ার নিয়ম প্রচলন ও অনুসরণের তাগাদা দিলেও তেমনভাবে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই তুলে দিলেও সেই বই আলমারি বা টেবিলে পড়ে থাকছে। তারা ব্যস্ত মোবাইল-ল্যাপটপে। সোশ্যাল মিডিয়া-ইউটিউব, এমনকি পর্নোগ্রাফির আসক্তিও কম নয় বলে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। নিঃসন্দেহে আগামী জাতি বা প্রজন্মের সুস্থ বিকাশ ও নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এই ট্রেন্ড অশনিসংকেত। আমাদের শিশু-কিশোরদের ফেরাতে হবে ধ্রুপদী সাহিত্যের দিকে। বাাড়িতে গড়ে তুলতে হবে লাইব্রেরি। পারিবারিক পরিমণ্ডলেই তৈরি করতে হবে দজরদারি। রাষ্ট্রকে দিতে হবে উৎসাহ-আনুকূল্য। তবেই হয়তো নৈতিকতার বিকাশ পুনরায় জাগবে। আমরা নৈতিক অবক্ষয় থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ জীবনযাত্রায় নির্মল বাতাস নিতে পারব। সবার মধ্যে তৈরি হবে বিবেক পরিচালিত ও মানবতা উৎসারিত কাম্য আচার-আচরণ। সমাজে কিশোর গ্যাং তাণ্ডবসহ সব অন্যায়-স্খলন-দুর্নীতি, এমনকি ভয়ংকর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।


লেখক: কথাসাহিত্যিক


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //