টাকা পাচারকারীরা এখন কোথায় যাবেন

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বা সুইস ব্যাংকে গত এক বছরে বাংলাদেশি নাগরিক ও ব্যাংকগুলোর জমা করা অর্থের পরিমাণ ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমে গেছে। এরকম একটি খবর যখন গণমাধ্যমে এলো, কাছাকাছি সময়ে জানা গেল যে, অর্থ পাচারের জন্য নিরাপদ গন্তব্য খুঁজছেন বাংলাদেশিরা।

একই সময়ের আরেকটি খবর, যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা হবে নাকি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হিসেবে পাঠ করা হবে?

প্রসঙ্গত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স আসত সবচেয়ে বেশি। কিন্তু গণমাধ্যমের খবর বলছে, সম্প্রতি সেই স্থান দখল করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ কম প্রবাসী থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে- যেটিকে নানা কারণেই সন্দেহ করা হচ্ছে। পাচার হওয়া টাকা রেমিট্যান্স আকারে ফিরে আসছে কি না, এমন প্রশ্নও উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে হঠাৎ রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে আখ্যা দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডিও। 

সংস্থাটি বলছে, গত অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সৌদি আরব থেকে ৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা চলতি বছরের জুলাই-এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। (মানবকণ্ঠ, ২৭ মে ২০২৩)।

এখানে বিষয় চারটি। ১. অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন, ২. টাকা পাচার, ৩. পাচারকৃত টাকার জন্য নতুন গন্তব্য খোঁজা এবং ৪. অস্বাভাবিক রেমিট্যান্স।

বলা হয়, সবচেয়ে বেশি অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ মূলত বড় বাজেটের সরকারি কেনাকাটা, উন্নয়ন প্রকল্প এবং সরকারি অফিসের ঘুষে। আরেকটি খাত হলো করপোরেট কর ফাঁকি। এসব ক্ষেত্রে যখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সুতা আলগা হয়ে যায়, যখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের শীর্ষ ব্যক্তিরাই দুর্নীতিগ্রস্ত থাকেন বা যদি তারা নির্লিপ্ত থাকতে বাধ্য হন, তখনই এসব খাত থেকে অসৎ লোকজন অবৈধভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ পান। আর অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ যেহেতু দেশের ব্যাংকে রাখা নিরাপদ নয়, ফলে নানা কায়দা-কানুন করে বিদেশে পাঠানো হয়। 

তবে অর্থ পাচারের পেছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন দেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা, ব্যবসার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি।

আবার অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থের বিরাট অংশ অবশ্য দেশেই থাকে। যেমন জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও গাড়ি কেনা। কিন্তু তারপরও অনেক টাকা পাচার হয়ে যায়। বিশেষ করে যারা দেশের ভেতরে দামি ফ্ল্যাট বা গাড়ি কিনলে সন্দেহের চোখে পড়বেন, তারা দেশেও কিছু কেনার সাহস করেন না। টাকা পাচার করে দেন। তাদের মধ্যে অনেকের গন্তব্য ছিল সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক। কারণ সেখানে অর্থের নিরাপত্তা তুলনামূলকভাবে বেশি। তাদের গোপনীয়তার নীতিমালা বেশ কঠিন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেসব জায়গায়ও টাকা রাখা নিরাপদ বোধ করছেন না বাংলাদেশিরা। তারা নতুন গন্তব্য খুঁজছেন। কারণ তাদের শঙ্কা, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে রাখা টাকাও হয়তো আটকে যেতে পারে। ফলে তারা এখন অধিকতর নিরাপদ ব্যাংক খুঁজছেন। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, বাংলাদেশি অর্থপাচারকারীদের নতুন গন্তব্য হিসেবে সামনে আসছে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। বিশেষ করে যেসব দেশে মার্কিন প্রভাব নেই এবং আর্থিক খাতে সুশাসন ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। 

সুইস ব্যাংকগুলোয় এখন আর আগের মতো ঢালাওভাবে অর্থ রাখা যাচ্ছে না তার আরেকটি কারণ তারা কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ আসছে তা প্রকাশ করা শুরু করেছে। ফলে পাচারকারীরা হয়তো ভাবছেন যে, ভবিষ্যতে সুইস ব্যাংক গ্রাহকদের নামও প্রকাশ শুরু করতে পারে।

বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না এবং যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে স্যাংশন দিয়েছে এবং আরও স্যাংশন আসতে পারে বলে আভাস আছে, ফলে সুইজারল্যান্ডের মতো এমন কোনো দেশে পাচারকারীরা তাদের অর্থ রাখা নিরাপদ বোধ করছেন না যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আছে। উপরন্তু চলতি বছরের শুরু থেকেই বিদেশিদের জন্য প্রপার্টিতে বিনিয়োগ কঠিন করে তুলেছে কানাডাও। সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৯৪ শতাংশ। (বণিকবার্তা, ২৫ জুন ২০২৩)। 

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশিরা যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তাদের গচ্ছিত অর্থ তুলে ফেললেন, এই টাকার ভবিষ্যৎ কী? এই টাকা কি তারা দেশে ফিরিয়ে আনবেন? দেশে আনলে সেগুলো কোন চ্যানেলে আনবেন? ব্যাংকিং চ্যানেলে আনলে সেগুলো কি আর্থিক ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার চোখে পড়বে না? সেই ঝুঁকি তারা কেন নেবেন? নাকি পাচারকারীদের মধ্যে যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো সমঝোতা হয়েছে যে, দেশে ফিরিয়ে আনলেও বিপদে পড়তে হবে না। তাতে করে সুবিধা দুটি। ১. যারা টাকা ফিরিয়ে আনবেন তাদের টাকা সুরক্ষিত হবে এবং ২. দেশ থেকে পাচার করা টাকা দেশে ফিরে এলে সেটি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত অর্থবছরে ট্যাক্স দিয়ে পাচার হওয়া টাকা বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তখন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, সেই দেশেও এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার ফলে অনেক টাকা দেশে ফেরত এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ঘোষণায় খুব একটা অর্থ দেশে ফেরত এসেছে- এমনটা শোনা যায় না। প্রশ্ন হলো, গত বছরের সেই ঘোষণার ফল কি এখন আসতে শুরু করেছে? এর সঙ্গে সম্প্রতি ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতি এবং সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েনের কি কোনো সম্পর্ক আছে?

বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় এ বিষয়ে একটি ধারণা দিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। তার তথ্য মতে, বিগত ৪৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

এটা ঠিক যে, অধিকাংশ পাচারকারীই দেশে টাকা ফিরিয়ে আনার সাহস করবেন না। কারণ তাতে ভবিষ্যতেও বিপদে পড়ার শঙ্কা থাকবে। ফলে শোনা যাচ্ছে এখন তাদের নতুন গন্তব্য তুরস্ক, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া ইত্যাদির মতো পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ। সরকারি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ব্যাংক খাতের নির্বাহীসহ বিভিন্ন খাতের দুর্নীতিগ্রস্তদের অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি বিনিয়োগ স্থানান্তরের তথ্য সামনে এসেছে। এছাড়া বারবুডা, কেম্যান আইল্যান্ডের মতো অফশোর বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দ্বীপদেশগুলোয়ও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের তথ্য শুনতে পাওয়া যায়। ফলে সুইস ব্যাংকে থেকে টাকা সরিয়ে বাংলাদেশিরা হয়তো এসব জায়গায়ও যেতে পারেন। 

তারা সত্যিই কোথায় নিজেদের পাচার করা টাকা নিয়ে যাবেন এবং সেই টাকার কত শতাংশ তারা বৈধ পথে দেশে ফিরিয়ে আনবেন এবং আনলে তার ফল কী হবে- সেটি একটি দিক। মূল বিষয় হলো বাংলাদেশ কেন অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে সেই টাকা বিদেশে পাচারের অভয়ারণ্যে পরিণত হলো? রাষ্ট্রের তদারকি সংস্থাগুলো কি ঠিকমতো কাজ করে না, নাকি পুরো সিস্টেমটাই এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে, চাইলেই এখানে অবৈধ পথে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া যাবে এবং সেজন্য কোনো ধরনের জবাবদিহির মুখোমুখি হতেই হবে না? 

শুধু অবৈধ পথে টাকা উপার্জনই নয়, বরং বাংলাদেশ কর ফাঁকিরও অভয়ারণ্য। ১৮ কোটি লোকের দেশে কর দেয় মাত্র কয়েক লাখ মানুষ। অথচ ঠিকমতো কর আদায় করা গেলে, সরকারি প্রকল্প ও কেনাকাটায় লুটপাট এবং সরকারি অফিসে ঘুষ বন্ধ করা গেলে বাংলাদেশের চেহারাটা সত্যিই বদলে যেত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //