এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল তুলে দিতে বাধ্য হন অভিভাবক। এ সময় প্রত্যেক বাবা-মার মনেই ইতিবাচক ভাবনার মধ্যে ছিল ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা অব্যাহত রাখা, অমনোযোগিতার হাত থেকে রেহাই পাওয়া, বাজে ধরনের সঙ্গ ও আড্ডা থেকে মুক্ত থাকা তথা বাইরে গিয়ে সময় না কাটানো বা বাসায় ঝগড়াঝাঁটি না করা প্রভৃতি।
আর নেতিবাচক ভাবনার মধ্যে ছিল অনলাইন ক্লাস চলতে পারে এমন মোবাইল সেট কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থকড়ি জোগানো, ইন্টারনেটের খরচ জোগানো ও অবাধ ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার নিশ্চয়তা, কোলাহলমুক্ত অবস্থায় ক্লাস করতে পারার পরিবেশ তৈরি প্রভৃতি। অবশ্য এসব কিছুর আড়ালে সর্বাগ্রে ক্রিয়াশীল ছিল স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভাবনা।
হ্যাঁ, আমি অতিমারি কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস চলা সময়ের কথাই বলছি। এ সময়ে লকডাউন ও শাটডাউন নামক চলাচল নিষেধাজ্ঞার কারণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও অনাকাক্সিক্ষত সাধারণ ছুটির কবলে পড়ে। ছুটির মেয়াদ বারবার বেড়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অনলাইন কা¬সের আয়োজন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
অভিভাবকদের একটা বড় অংশ নানা রকমের ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কল্যাণের কথা চিন্তা করে অনলাইন ক্লাসের মূল উপাদান মোবাইল সেট কিনে দেন। ছেলেমেয়েরা গণিত, ইংরেজি প্রভৃতি অধিক প্রয়োজনীয় ক্লাসগুলো সেরে নিচ্ছিল এই সুযোগে। যদিও শিক্ষা অর্জনের বিষয়টিতে স্বয়ং শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা লক্ষ করেছি। অনলাইন ক্লাস নিয়েছেন, সারা দেশের এমন অর্ধশতাধিক শিক্ষকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে এ বিষয়ে।
কোভিড-১৯-এর আতঙ্কের অবসান হয়ে এখন যথানিয়মে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস চলছে। কিন্তু মোবাইল ফোনের অযাচিত ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার রয়েই গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক অভিভাবককে জিজ্ঞাসা করেছি: আপনার শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রধানত কী কী সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন? প্রায় সকলের জবাব একটিই-মোবাইল থেকে ছেলে-মেয়েকে সরানোই যাচ্ছে না।
আবার একটি শক্ত যুক্তিও তাদের রয়েছে-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নানা তথ্য মেসেজ বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে জানানো হয় অথবা কোনো বিশেষ পড়ার বিষয় ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করতে বলা হয়। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোনের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রেখেছে, সে প্রতিষ্ঠানই আবার শিক্ষার্থীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ গঠন করে দিয়েছে! কোনো কোনো গৃহশিক্ষকও এমনটি করে থাকেন।
কিন্তু বাস্তবে অতীব জরুরি কাজ ছিল শিক্ষার্থীকে যতদূর সম্ভব ইন্টারনেটের নির্ভরতা থেকে মুক্ত করে প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ প্রভৃতির দিকে আকৃষ্ট করা, যার মাধ্যমে শিক্ষা টেকসই হয়ে ওঠে এবং সর্বোপরি, নিজেকে স্বাধীন মানুষ হিসেবে বিবেচনার সার্বিক উপাদান সংগ্রহের নিশানা খুঁজে পেতে পারে। শিক্ষার্থী হবে বিজ্ঞানমনস্ক, অনুসন্ধিৎসু, তারা নতুন নতুন তথ্য জানবে, দেখবে, যাচাই করবে, সারা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়াবলি বুঝে রাখবে। আমার মনে হয়, অন্তত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত এদেরকে অনলাইন শিক্ষার বাইরে রাখা উচিত।
এভাবে অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক স্বাভাবিক সম্পর্ক দৃঢ়তা হারাচ্ছে, মা-বাবার আশা ও স্বপ্ন অনেকটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের খরচ জোগাতে গিয়ে বাবা-মার সঙ্গে ছেলেমেয়ের মাঝে মাঝে ঝগড়াও হচ্ছে। পারিবারিক সম্পর্কের অবনতির পাশাপাশি আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।
বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যকার আড্ডার চেহারাও অনেক বদলে গেছে। দেখা যায়, ৪/৫টি ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে রয়েছে, কোনো কথা নেই-যার যার মতো মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। এমনকি বিয়েবাড়ির মতো জায়গায়ও কিশোরদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস আগের মতো দেখা যায় না; হাতে মোবাইল আছে আর লাগে কী? সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক. ইমো, টিকটক, ফ্রিফায়ার প্রভৃতিতে এরা এতই আসক্ত যে, অন্য কোনো বিষয়কে এরা বিষয়ই মনে করে না।
রাজশাহীর কাকনহাটে আমার এক পরিচিত ছেলে (সবে কলেজে পা দিয়েছিল) বাসার নিকটস্থ রেললাইনে বসে মোবাইলে গভীর মনোসংযোগের কারণে রেলের ঘন ঘন সঙ্কেত সত্তে¡ও স্থান ত্যাগ করতে পারেনি। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক অধ্যাপক প্রাণগোপাল দত্ত শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন, ‘মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে।
সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন মোবাইল ফোনকে সিগারেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।’ আর প্রত্যক্ষ কুফল যা ইতোমধ্যে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, তা হলো, ছেলে-মেয়ে রুক্ষ. খিটখিটে, মেজাজি ও বাস্তব জীবনের জন্য অনুপযোগী হয়ে উঠছে। সঙ্গে সামাজিক ও মানসিক বিচ্ছিন্নতার যোগও রয়েছে।
অভিভাবকদেরও দায় রয়েছে এ ক্ষেত্রে। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ১০ শিশুর ৪ জন এবং প্রতি ১০ বাবা-মার ৬ জন একে অপরের বিরুদ্ধে ইন্টারনেটের আসক্তির কথা তুলে ধরেছে। বাংলাদেশে সংখ্যা বা অনুপাত সে রকম হয়তো হবে না, কিন্তু বাবা-মার একটা বিবেচনাযোগ্য অংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন, এটি মিথ্যে নয়। জার্মানির হ্যামবুর্গে গত বছর বাবা-মার অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার ও শিশুদের প্রতি অবজ্ঞার প্রতিবাদে শিশুরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। দলনেতা এমিল বাবা-মার উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে খেলো, স্মার্টফোনের সঙ্গে নয়।’
আমাদের দেশে বর্তমানে শিশুকাল থেকেই সন্তানের খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ-বিনোদন, হাসি-কান্না- সবকিছুতে মোবাইলের যথেচ্ছ ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। চাকরিজীবী বাবা-মা শিশুদের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে কতকটা নিশ্চিত থাকার প্রয়াস পান, যদিও এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রতি তিন জনে একজন শিশু। প্রতিদিন ১,৭৫,০০০ শিশু (প্রতি সেকেণ্ডে ২ জন) ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী দৈনিক ছয় থেকে আট ঘণ্টা বা এরও অধিক সময় এ কাজে ব্যয় করে থাকে।
শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে যে মননবৃত্তির সৃষ্টি হয়, সেটিই জাতির আসল পথপ্রদর্শক। এর ব্যত্যয় ঘটলে পদে পদে বিপত্তি। যে মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে অনলাইন শিক্ষার প্রচলন হয়েছিল, তা আজ ছাত্রছাত্রীদেরকে ঠেলে দিয়েছে এক লক্ষ্যহীন আসক্তির দিকে, এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। বিষয়টি নিয়ে একটি নিবিড় অংশগ্রহণমূলক গবেষণাকর্ম পরিচালনা প্রয়োজন, যাতে সমস্যার প্রকৃতি, প্রকোপ, কারণ, ধরন, ফলাফল এবং সমাধানের সম্ভাব্য উপায় বের হয়ে আসতে পারে। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন একে একটি সমস্যা হিসেবে স্বীকার করা, আমলে নেওয়া।
গবেষক, মানবাধিকারকর্মী
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh