ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘ব্যাংকিং অন ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার উল্লেখ করেন, খেলাপি ঋণ কমানো ও করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং  সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে ব্যাংকের ব্যবসার বৈচিত্র্য বাড়বে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন।

অন্যদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের অভিমত হচ্ছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে তফসিলি ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়, এই কাজের জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। তাদের আরও বক্তব্য হচ্ছে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে এবং এ খাতে লোকবল বাড়াতে হবে। 

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের। বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাই ব্যাংক খাতের জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকারগণ হতাশ হয়ে এখন আইনি কাঠামো শক্ত করে চোর ডাকাতের মতো ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিতে চাচ্ছে, জেল জরিমানা করে খেলাপিদের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির পরিবেশ তৈরির প্রত্যাশা করছে। কিন্তু আদালতে মামলা হলে ঋণখেলাপি স্বস্তি পায়, ঋণ গ্রহীতার মৃত্যু পর্যন্ত মামলা চলতেই থাকে; কারণ অর্থ ঋণ আদালতে কোনো মামলায় ব্যাংক বিজয়ী হলেও সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য আরেকটি মামলা করতে হয়, অন্যদিকে খেলাপি গ্রাহকের উচ্চ আদালতে রিট করার সুযোগ তো সব সময়েই থাকে। গভর্নর বলছেন, খেলাপি ঋণ কমানোর দায়িত্ব ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন তাদেরই নিতে হবে। ব্যাংকের শীর্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নেওয়া উচিত; কারণ প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে জাতীয় বেতন স্কেলের কোনো সঙ্গতি নেই, ঈর্ষণীয় বেশী। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এত উচ্চ বেতনের কর্মকর্তার দায়িত্বও উচ্চ থাকা অপরিহার্য। উচ্চ বেতন কাঠামোর কর্মকর্তাদের দায় ও দায়িত্ব অর্পণযোগ্য নয়। মামলা ঠুকে দিয়ে দায় ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল বন্ধ করা জরুুর। 

গভর্নরের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের শুধু ‘দূরদর্শী নীতিমালা’ প্রণয়নে আবদ্ধ থাকার মধ্যে সমাধান নিহিত নয়। বর্তমান গভর্নর বহু বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি নির্ধারণের সঙ্গে জড়িত; তিনি গভর্নর হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের পরিচালক ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণে পরিচালক পর্ষদের সম্মতি অপরিহার্য। তিনি নিশ্চয়ই যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন। আমার ধারণা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদের কিছু সদস্য নিজস্ব দাপ্তরিক কাজে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, পর্ষদ সভায় উপস্থাপিত স্মারকগুলো পড়ে দেখার সময়ও পান না, অনেকে অফিস থেকে সভায় আসার পথে ট্রাফিক জ্যামে গাড়িতে বসে একটু চোখ বুলিয়ে নেন। এই সকল পর্ষদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, আমলারা সেনা সদস্যদের মতো বড় কর্মকর্তাদের সমীহ করেন, সিনিয়র আমলার মতের বিরোধিতা করে পর্ষদ সভায় ঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধস্তন আমলারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ যথাযথ ভূমিকা পালন করলে ব্যাংকিং জগৎ নিয়ে সরকারকে এত বিব্রত হতে হয় না। আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার খবর অহরহ মিডিয়ায় আসছে। অব্যবস্থাপনার কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংকের ওপর জনগণের আস্থা এখনো ফেরত আসেনি, পদ্মা ব্যাংক তাই বোধহয় তাদের নিট লোকসানকে ‘ইনটেনজিবেল অ্যাসেট’ বলছে। 

মূল্য বৃদ্ধির কারণে ভোক্তার চাহিদা কমছে, চাহিদা কমায় আমাদের রপ্তানি কমছে। একই যুক্তিতে আমাদের চাহিদা এবং আমদানি কমার কথা, কিন্তু তা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে হচ্ছে না; কারণ নিত্য ব্যবহার্য পণ্য, জ্বালানি তেল এবং পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমানোর কোনো উপায় নেই। বিশ্ব মন্দায় বস্ত্রের চাহিদা কমে গেলে পোশাক শিল্পের ওপর অতি নির্ভরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং অবরোধ আরোপের হিড়িক বন্ধ না হলে দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাবে, ব্যাংকে অলস টাকা ও খেলাপি ঋণ আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের দূরদর্শী নীতি প্রণয়নও নির্ভর করছে বিশ্ব পরিস্থিতির ওপর। 

উন্নত দেশগুলোতে এখনো লোকজন ঘরে বসে নেটের মাধ্যমে অফিসের কাজ করছে। আর বাংলাদেশে এখনো বিভিন্ন অজুহাত সৃষ্টি করে সরকারের লোকজন বিদেশে যাচ্ছেন। জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কর্মশালা, সেমিনার বা প্রশিক্ষণে যোগদান বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয়। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থায় এগুলোরও প্রয়োজন আছে, কিন্তু এখন নয়। রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে বিদেশে বক্তৃতা দিতে যারা যাচ্ছেন তাদের পক্ষে সামান্যতম অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে হয় না; কারণ হুন্ডির লাভ বক্তৃতা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হচ্ছেন অসংখ্য ব্যবসায়ী, সাংবাদিক; তাদের জন্য সরকারের খরচ না হলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা কিন্তু ব্যয় হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটে বিপিএল ক্রিকেটের আয়োজন জরুরি ছিল বলে মনে হয় না। দূরদর্শী নীতি প্রণয়নে এই সকল সাধারণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। 

ঋণের মান কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাহলে কি এতদিন যথাযথ আঙ্গিকে যাচাই করা হতো না? না হলে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে না কেন? প্রতিটি ব্যাংকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ রয়েছে, নিয়মিত নিরীক্ষণ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও নিয়মিত পরিদর্শন হয়। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালক পর্ষদে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকেন। পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষা বা পরিদর্শন কোনোটাই কাজে আসছে না। দুর্নীতি ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কথা অস্বীকার করা যাবে না। তাই বলে পরিদর্শন ও তদারকির নামে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়। প্রতিটি লোন কেস যথাযথভাবে যাচাই করা সমীচীন; কিন্তু যাচাইয়ের নামে কালক্ষেপণ অপরাধ, বিলম্বিত সিদ্ধান্তে পরিস্থিতির পরিবর্তনে প্রকল্পে বিনিয়োগ অলাভজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণে অযাচিত বিলম্ব দুর্নীতির বাসা বাঁধতে সহায়তা করে। 

পর্যাপ্ত জামানত না নিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় লোন দেওয়া হলে লোন আদায়ের ঝুঁকি বাড়ে। বর্তমান গভর্নর আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ইমেজ একটু বেড়েছে। বর্তমান গভর্নর অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকছেন, কারও তোষামোদিতে বিগলিত হচ্ছেন না, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয় তা তফসিলি ব্যাংকের এক্তিয়ারে ছেড়ে দিচ্ছেন। পুনঃতফসিল বা বড় লোনগুলোর অনুমোদন এখন স্ব স্ব ব্যাংক তাদের নিজ দায়িত্বে করে থাকে। তবে প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা, সততা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায়িত্ব রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের প্রতি আস্থা স্থাপন করলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার, খেলাপি ঋণের কারণে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোই সমস্যায় পড়ছে না, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বহুদিন আগে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্সশিট পরিষ্কার করা হয়েছিল, কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছিল। কিন্তু এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বারবার খেলাপি ঋণ কমানো সঠিক নয়, কারণ অবলোপন করার পর তা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়, ব্যাংকারগণও তা আদায়ের কথা ভুলে যান। খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে থাকলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, প্রকৃত উদ্যোক্তা ঋণ পাবে না। বাজার অর্থনীতির কাজ হচ্ছে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মধ্যস্বত্বার সৃষ্টি করা, এতে অর্থনৈতিক কর্মকা- বাড়ে, কর্মসংস্থান হয়। ব্যাংকের ব্যর্থতায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায় জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দাভাব তা কাটিয়ে উঠতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মানুষের আয় বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বাড়াতে হলে অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকা- বাড়াতে ও প্রকৃত উদ্যোক্তাকে সময়মতো প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান দিতে হবে। ঋণের জোগান দিতে হলে খেলাপি ঋণ হ্রাস করতে হবে। ব্যাংকের সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি, তাই বড় বড় কোম্পানিগুলোকে লোন দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করে নিজের অবস্থান দুর্বল করছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো জিইয়ে রাখার কোনো মানে হয় না, বড় ও শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করে দেওয়াই শ্রেয় হবে। ঘটনা ঘটার বৎসরাধিক পরে পরিদর্শনপূর্বক আরও বৎসারাধিক কাল অতিবাহিত করে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শিত ব্যাংককে অনিয়ম নিয়মিত করার জন্য নির্দেশনা দেওয়ার বিলম্বিত রীতি বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিবর্তন করতে হবে।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //