সুদানের গৃহযুদ্ধ

বিগত কয়েক দিন যাবৎ সুদানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সেনাবাহিনী এবং আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। মুখোমুখি এই সশস্ত্র সংঘর্ষে পাঁচ শতাধিক মানুষ মারা গেছে, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখল করে সেই স্থানে অবস্থান নিচ্ছে। সেনাবাহিনীর দুই জেনারেলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সৃষ্ট দ্বন্দ্ব থেকে এই সংঘর্ষের উদ্ভব।

২০১৯ সালে এক গণ-অভ্যুত্থানে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হন, তার ক্ষমতাচ্যুতির পর সেনাদের জেনারেল এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব মিলে দেশ শাসন শুরু করলেও অল্প কিছু দিনের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃত্বের মধ্য দ্বন্দ্ব তৈরি হয়; এ অবস্থায় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক কর্তৃত্বকে সরিয়ে দিয়ে ২০২১ সাল থেকে জেনারেলদের একটি কাউন্সিল দেশটি শাসন করছে। কিন্তু পরে বিভিন্ন ইস্যুতে জানারেলদের মধ্যেও তৈরি হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে দেশটির প্রেসিডেন্টও; অন্যদিকে দেশটির উপ-নেতা জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স বা আরএসএফের কমান্ডার। অথচ সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতা থেকে সরাতে তারা দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন।

বেসামরিক শাসনে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা অনুযায়ী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সকে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব থাকায় দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স বা আরএসএফ তাদের বিলুপ্ত করার বিপক্ষে এবং এই পরিকল্পনা থামানোর জন্য তারা তাদের বাহিনীকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। ফলে এক লাখ সদস্যের র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত না থামার ঘোষণা দিয়েছে। ঈদুল ফিতরের জন্য যুদ্ধবিরতি করার আহ্বানেও সহিংসতা থামেনি। রাজধানী খার্তুম শহরে বিমান হামলা, বোমা বিস্ফোরণ, গোলাবর্ষণ ও বন্দুকের গুলিবিনিময় অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

সেনাবাহিনীর বাইরে এক লক্ষ সশস্ত্র লোকের সমন্বয়ে গঠিত র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের শক্তিশালী উপস্থিতিই সুদানের অস্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান কারণ।

২০১৩ সালে গঠিত এই আধা-সামরিক বাহিনীর লোকগুলো জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং আরবীয় সশস্ত্র দল জানজাওয়িদ দাফুরের ফুর, যাঘাওয়া ও মাসালিত উপজাতি গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করে বিদ্রোহীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিল। ভিন্ন জাতি নির্মূলের এই অভিযানে হয়েছে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, বাড়িঘরে আগুন, ধর্ষণ ও অপহরণ। এই মিলিশিয়া গ্রুপ এমন গণহত্যা শুরু করেছিল যে, কয়েক লক্ষ লোক পার্শ্ববর্তী দেশ শাদে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করে। দারফুরে গণহত্যার অভিযোগে তখন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযুক্ত করা হয়। সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির এই মিলিশিয়া গ্রুপটিকে স্বীকৃতি দিয়ে যে ভুলটি করেছিল তার খেসারত দিচ্ছে এখন দেশটি। ২০১৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কর্নেল ওমর আল-বশির প্রায় ৩০ বছর ধরে সুদানের ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনিও ক্ষমতায় আসেন রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তিনি সুদানে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ইসলামি আইন চালু করেছিলেন।

সুদান পৃথিবীর সবচেয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ববহুল দেশ। ১৯৫৬ সালে মিশর-ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের এক বছর পূর্ব থেকেই সুদানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলের আশঙ্কা ছিল, স্বাধীনতা অর্জনের পর সুদানের উত্তরাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী দক্ষিণের সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের উপর কর্তৃত্বসুলভ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। অবিশ্বাস আর অনাস্থার মধ্যে ১৯৭২ সালে সুদানের দক্ষিণ অংশকে আংশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালে সুদানের দক্ষিণভাগে তেল আবিষ্কার হলে সরকার এই তেল আহরণের জন্য অঞ্চলটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে নতুন উত্তেজনার উদ্ভব ঘটায়; এমন উত্তেজনার মধ্যে ১৯৮৩ সালে সুদানকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং ১৯৮৯ সালে ক্ষমতায় এসেই কর্নেল ওমর আল-বশির সুদানে ইসলামি শরিয়াহ আইন প্রবর্তন করেন। ৬০ শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও অবিভক্ত সুদানে প্রায় ৫৯৭টি জাতি ৪০০টি ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। মুসলিম অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলেও অমুসলিম অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চল অনুন্নত ও অনগ্রসর। বেশিরভাগ আরব মুসলমান সুদানের উত্তরভাগে বসবাস করে এবং দক্ষিণভাগে বসবাস করে আফ্রিকান উপজাতি। 

দীর্ঘদিন ধরে চলা দ্বন্দ্ব সংঘাতের পর আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ সুদান ২০১১ সালে বিভক্ত হয়ে গেলে দক্ষিণ সুদানের জন্ম হয়। শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে শরিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ সহায়ক। কারণ শরিয়া আইনের সমালোচনা করা যায় না, এই আইনের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করা যায় না। শরিয়া আইনের বাস্তবায়ন হলে সুদানের নাগরিকদের কণ্ঠরোধ হয়ে যায়, নারীরা গৃহবন্দি হয়ে পড়ে এবং শরিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির ৩০ বছর একনাগাড়ে শাসন করার সুযোগ পেয়ে যান। শরিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগে রাজনৈতিক দলগুলো শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থায় সুদানিজ প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্বে পরিচালিত গণ-আন্দোলনে ২০১৯ সালে ওমর আল-বশিরের ৩০ বছর শাসনের অবসান ঘটে। আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের ৭০ শতাংশই ছিল নারী। শরিয়া আইনে সুদানের নারী সমাজ ছিল বেশি নিগৃহীত। নারীদের চলাফেরায় ছিল নানা বিধিনিষেধ, রাস্তায় পাথর ছুড়ে নারীর অপরাধের সাজা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গণ-আন্দোলনে রাজনৈতিক পরিবর্তনসহ সুদানে শরিয়া আইন বাতিলের দাবি তোলে নারীরা। ওমর আল-বশিরের পতনের পর সামরিক ও বেসামরিক সদস্যদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিল নারীদের পোশাক ও চলাচলের স্বাধীনতা খর্বকারী একটি বৈষম্যমূলক আইন বাতিল করে। শুধু তাই নয়, সুদানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ৩০ বছর পর দেশটির সংবিধান থেকে ইসলামি আইন ও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র এক সময় সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করত; আল কায়েদার ঘাঁটি থাকায় যুক্তরাষ্ট্র সুদানের রাজধানী খার্তুমে কয়েকবার মিসাইল হামলাও চালিয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারণে দেশটি এগুতে পারছে না। প্রতিবেশী দেশ শাদের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো নয়, ২০০৫ সালে সুদানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল শাদ। শাদ বিবদমান বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপকে অস্ত্র সরবরাহ করে থেকে। ২০০৮ সালে সুদান শাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়ার কারণে সুদানে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারেনি, গণতন্ত্র বিকশিত হতে না পারার কারণে সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ নিয়ন্ত্রণহীন। বেসামরিক সরকারের কাছে দেশটির শাসনভার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সামরিক বাহিনীর ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সামরিক সরকারের শাসন দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে পারে।


লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //