পারিবারিক সহিংসতা রোধে প্রয়োজন যৌথ পরিবার

যাদের বয়স কমপক্ষে ৪০/৫০-এর কোঠায়, যাদের বেড়ে ওঠা হোক গ্রামে বা শহরে; তাহলে তারা একটি যৌথ পারিবারিক সমাজ থেকে উঠে এসেছে-এ কথা বলা যেতে পারে। এই জেনারেশনটিই হয়তো যৌথ পরিবারের শেষ প্রজন্ম। আমি ৮০/৯০ দশকের কথা বলছি। যাদের বয়স আরও বেশি তারা আরও শক্তিশালী যৌথ পরিবারের ফসল। 

আমরা আমাদের শৈশব, কৈশোরে এক দারুণ সমাজ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি। যে সমাজ ব্যবস্থায় যেমন শাসন ছিল তেমনি মায়াও ছিল। আজকাল কোথাও মায়া দেখি না। কারও প্রতি কারও সহানুভূতি দেখি না। একটা মেকি সমাজের মধ্যে আমরা বাস করছি। যে সমাজের নীতি হয়ে গেছে ‘একলা বাঁচো’। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজের নীতি এমন নয়। যে সমাজ ব্যবস্থা আমরা দেখে বড় হয়েছি সে সমাজ সমষ্টিগত, কল্যাণকর্মে সংঘবদ্ধ, অনুভূতিশীল।

আমরা একটা বড় ক্যানভাসের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি যেখানে সবাইকে আত্মীয়, প্রতিবেশীকে আপন, অচেনাকে চেনা ভেবেছি। সমষ্টিকে আঁকড়ে থেকেছি, সামাজিক উৎসব-পার্বণে এক হয়ে অংশগ্রহণ করেছি। দাদাবাড়িতে যেমন বাবা-মা-চাচা-চাচি-ভাইবোন-চাচাতো ভাইবোন-পাড়াতো দাদা-দাদি-শিক্ষক- ইমাম, নানাবাড়িতেও সবাই আমরা আমাদের নিজেদের আপন ভেবেছি। বাল্য বয়সে কোনো ভুলে প্রতিবেশীরা শাসন করলে বাবা মা খুশি হতেন, এখন হয় উল্টো। 

আমরা আজ অন্যরকম একটা সমাজের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে সম্পর্কগুলো স্বার্থময়। পারিবারিক বন্ধনগুলো হারাতে বসেছি। আমরা সংসার করছি পরস্পরের বিপরীত দিকে তাকিয়ে। স্বার্থের জন্য পরিবারের মানুষদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছি। আজ মায়ের বিরুদ্ধে বাবা, ভাইয়ের বিরুদ্ধে বোন, স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামী। এমন সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় কী করে ঢুকল? বাংলাদেশের সমাজ তো ছিল সহনশীল। যে দেশে গ্রামের মধ্য দিয়ে শান্ত নদী বয়ে যায়, সে দেশের সমাজের মানুষ তো হিংস্র হতে পারে না। হওয়ার কথা নয়। এর সূত্র কোথায়?

আমার মনে হয়ে এর একটি কারণ শাসন। শিক্ষকেরা আমাদের শৈশবে যেমন স্নেহ করেছেন তেমনই শাসনও করেছেন আমাদের মঙ্গলের জন্য। অভিভাবকরা নিজের সন্তানকে শিক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, ‘হাড়গুলো আমার, মাংসগুলো আপনার।’ শিক্ষকের একটা গাইড ছিল ছাত্রছাত্রীদের প্রতি। সেটা এখন নেই। সমাজে শিক্ষকদের একটা শ্রদ্ধার জায়গা ছিল।

তার প্রমাণ পাই গল্পে, নাটকে এমনকি বিজ্ঞাপনেও। নাটকের পাত্রপাত্রী কোনো সমস্যায় পড়লে যেত মাস্টার মশাইয়ের কাছে পরামর্শ নিতে। বিজ্ঞাপনে দেখেছি কাস্টমার কোন টিন কিনবে বা কোন পণ্য কিনলে ভালো হয় সে পরামর্শের জন্য একটা চরিত্র আসত মাস্টার মশাইয়ের।

আমাদের কৈশোরে দেখেছি গ্রামে অবস্থাসম্পন্ন গেরস্ত বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য জায়গির মাস্টার থাকত। সে মাস্টারও তখন ছাত্র থাকত উঁচু ক্লাসের। হয়তো দূর কোনো গ্রামে তার বাড়ি, অতদূর থেকে কলেজে ক্লাস করা সম্ভব ছিল না, হয়তো সচ্ছলতাও ছিল না তেমন। তাই তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশের গ্রামে জায়গির থাকত। তারাও সমাজের শিশুকিশোরদের আলোকিত করে গড়ে তোলার কাজে সম্পৃক্ত থাকত। সেই প্রচলন এখন নেই।

এই প্রেক্ষাপটটা ছিল নব্বই দশক পর্যন্ত। মাস্টার মশাইয়ের সম্মানও আগের মতো নেই। এখন মাস্টারমশাইরা ছাত্রদের ভুল ধরে শাসন করার সাহস পান না। এখন ছাত্ররা মাস্টার মশাইদের ভুল ধরে, শাসন করে, শারীরিক প্রহার করে, অপমান করে, এমনকি ছাত্রের হাতে শিক্ষকরা খুন পর্যন্ত হন । সেই খুনের আবার বিচারও হয় না। আগে শিক্ষককে দেখে তটস্থ থাকত ছাত্ররা, এখন ছাত্রদের দেখে তটস্থ থাকেন শিক্ষকরা।

সেই সোনার শিক্ষকদের আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সমাজের একটি আলোকিত প্রদীপ শ্রেণিকে আমরা নিভিয়ে দিয়েছি। হয়তো আজকের সমাজের এই অস্থির প্রেক্ষাপটটা তৈরি হয়েছে সেই আলোকিত মানুষদের অভাবে।

পরিবার একটা বড় শিক্ষালয়। পরিবার কীভাবে রচিত হতো। নতুন সংসার নির্মাণ দিয়েই শুরু করি। একসময় যারা পাত্রপাত্রীরা কেউ কাউকে চিনত না, এমনকি দেখাও হতো না। সব আয়োজন করত সমাজের মুরব্বিরা। তারা পাত্রপাত্রী নির্বাচন করত যে প্রক্রিয়ায় তাতে করে সংসার দীর্ঘস্থায়ী হতো। পাত্রপাত্রীর কাজ ছিল শুধু কবুল বলা। তাদের প্রথম কথা হতো বাসর রাতে, সেখান থেকেই তাদের জীবন শুরু হতো।

ফলে তাদের কোনো অতীত থাকত না। বলতে পারত না -‘বিয়ের পরে তুমি অনেক বদলে গেছো।’ পরিবারের সবার সঙ্গে নবাগত এই নারীর রচিত হতো মধুর বন্ধন। বলতে চাইছি না- প্রেমের সম্পর্ক মধুর হয় না। অবশ্যই হয়। সে প্রেম সে মায়া যদি থাকে সমষ্টিগত। কিন্তু কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের আধুনিক তথাকথিত একক পরিবার। 

আজকের সমাজে আমরা কী দেখতে পাই? যৌথ পরিবারকে গলাটিপে হত্যা করে একক পরিবার গড়ে তুলছি। একক পরিবার একটি চৌবাচ্চার মতো, যার চারদিকে সংকীর্ণতার ব্যারিকেড। সেখানে আধুনিক জীবনযাপনের সবকিছুর প্রবেশাধিকার আছে, শুধু মানুষের নেই। সংবাদপত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন ঘটছে এই পারিবারিক সহিংসতা।

এ থেকে মুক্তির পথ কী? নিশ্চয়ই আছে। সমস্যা যেখান থেকে শুরু সমাধানটা সেখানেই আছে।

আমরা এক অভিভাবকহীন সমাজের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যে অভিভাবক যুগ যুগ ধরে, শত শত বছর ধরে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে সুস্থ ও স্বাচ্ছন্দ্যে রেখেছে। আমরা সেই অভিভাবককে ফিরে পেতে চাই। সেই অভিভাবকের নাম ‘যৌথ পরিবার’। সেই শেকড়েই রয়েছে আমাদের আজকের তৈরি বেপরোয়া সমাজব্যবস্থার সকল সমাধান। আমাদের একক পরিবারের সৃষ্ট ঝড়ো হাওয়া থেকে মুক্তি পেয়ে এক স্নিগ্ধ সমাজে ফিরতে হলে ফিরতে হবে যৌথ পরিবারে।

সময় বদলেছে। কর্মসূত্রে একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন; হয়তো আগের যৌথ পরিবারের কাঠামোতে আমরা ফিরে যেতে পারব না। কিন্তু পরিবার তো রয়েছে। আমরা যে যেখানে থাকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখতে পারি। এখন যোগাযোগ যে সশরীরে করতে হবে, তাও নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা পরিবারের সঙ্গে একটু সময় কাটাতে পারি।, কথা বলতে পারি, ভিডিওকলে পরস্পরকে দেখতে পারি। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে সবাই মিলে আলোচনা করতে পারি। এই যে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বেঁচে থাকার মধ্যে অপার আনন্দ, তা থেকে নিজেকে কেন বঞ্চিত করব?

আরেকটি মাধ্যমের কথা, আমরা টেলিভিশন নাটকে এখন আর তেমন পারিবারিক গল্প দেখি না। দুটি চরিত্রের গল্প রচিত হয়। প্রেমের ক্ষেত্রেও দুটি চরিত্র যেন সর্বক্ষণ সন্দেহাতীতভাবে সাংঘর্ষিক আচরণে। আমাদের ফিরতে হবে পারিবারিক গল্পে। আমরা সেই যৌথ পরিবারের ইতিবাচক গল্প দেখতে চাই রুপালি পর্দায়।

আসুন আমরা বাঁচি আমাদের ঐতিহ্যিক যৌথ পরিবারে। যেখানে থাকেন সেখান থেকেই যুক্ত হোন যৌথ পরিবারে। এটাই আমাদের বাঙালির সভ্যতা গঠনের অভিভাবক।

কবি ও অভিনেতা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //