ফেসবুক ও আমাদের জীবনাচরণ

বর্তমান সময়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাপ্ত হয়ে আছে ফেসবুক। আন্তর্জাতিক সমীক্ষাগুলোর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ দশমিক ৮ কোটি। 

দ্য হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত মেটার সাম্প্রতিক এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারী শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। দেশের যে জনগোষ্ঠী ফেসবুক ব্যবহার করছে শ্রেণীগত অবস্থান থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যায় সর্বাধিক। 

এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনাচরণে ফেসবুক ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। এই প্রভাবের প্রতিফলন আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপরেও পড়েছে। 

ফেসবুকের জন্মলগ্ন সময় থেকেই এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি প্রভাব নিয়েই আলোচনা হয়েছে। দিন যতো পার হয়েছে এই আলোচনা আরও বেশি তীব্র হয়েছে। ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেটিই বলি না কেন, এটা মানুষের সরাসরি মনস্তত্বে প্রভাব বিস্তার করছে। 

ফেসবুকের উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে বলা হয়, এর মাধ্যমে একটি বিস্তৃত ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, ফলে একসাথে অনেক মানুষ একে অপরের সাথে যুক্ত হতে পেরেছে। বলা হয়ে থাকে, ফেসবুকের মাধ্যমে একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ সরাসরি তাদের মত ও অনুভূতি, ভৌগলিক-সামাজিক অবস্থান এগুলো প্রকাশ করতে পারছে। ফেসবুককে সামাজিকভাবে সচেতন করার একটি মাধ্যম হিসাবেও বিবেচনা করা হচ্ছে। 

উপরের যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম সেগুলো ফেসবুকের বৈশ্বিক বৈশিষ্ট্য। আমি আলোচনায় এই বিষয়গুলোকেই আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনাচরণে কি ধরণের প্রভাব তৈরি করছে তার একটি দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে চাই। 

প্রথমেই আসা যাক ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক এর বিষয়ে। নিশ্চয় খুব অল্প সময়েই ব্যাপক মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করছে। যদিও এই সংযোগের মধ্যে গভীরতা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব না থাকলেও তারপরেও আমরা এটিকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখি। কিন্তু দ্বান্দ্বিকভাবে দেখলে দেখবো, এর প্রভাবে একটি নেতিবাচক প্রভাবও আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে পড়ছে। 

ফেসবুক ব্যবহার শুরু হওয়ার পূর্বে তখন কি আমাদের মধ্যে এই নেটওয়ার্কিং ছিলো না? অবশ্যই ছিলো। হয়তো সার্কেলটা এখনকার মতো এতোটা বিস্তৃত না হলেও, ছিলো তো! এবং উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এই নেটওয়ার্কিং ছিলো সশরীরের। অর্থাৎ ফিজিক্যালি একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা হতো, কথা হতো, আড্ডা হতো, মতবিনিময় হতো। আরও অনেক কিছুই হতো। সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি ঘটতো এক অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা! ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কিং এর প্রভাবে সেটি বন্ধ হওয়ার পথে। 

ফলশ্রুতিতে আমাদের একে অপরের প্রতি যে বন্ডেজ দেখা যেতো এখন সেটি অনেকটাই কমে গেছে। ফেসবুক ব্যবহার শুরু হওয়ার পূর্বে যার সাথে হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও সপ্তাহে এক বা দুই দিন দেখা হতো এখন তিন মাসে-ছয় মাসে সেই দেখাটা হয়। সশরীরে যোগাযোগ এর মাধ্যমে যে ভাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ, দায়বোধ তৈরি হয় ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে কখনোই সেটা সম্ভব হয় না। 

ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কিংয়ের সদস্যরা পরস্পর পরস্পরকে অভিহিত করে থাকি ‘ফেসবুক ফ্রেন্ড’ হিসেবে। যার সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫০০০ নেটওয়ার্ক মেম্বার আছে তার মধ্যে সে বড়জোর ১ হাজার মানুষকে ফিজিক্যালি চেনেন। আর বাকিরা সকলেই ভার্চুয়াল জগতের। 

প্রতিদিন চেনা-অচেনা কতো মানুষের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আমরা, এমনভাবেই কতো মানুষের পোস্টে আবেগঘন কমেন্ট করছি; অথচ সেই মানুষটিই চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু তাকে চিনতে পারছি না! 

কেনো পারি না আমরা চিনতে? কারণ যাদেরকে আমরা যুক্ত করছি তাদের অধিকাংশকেই আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনে যুক্ত করছি না। আমার প্রোফাইলে ফ্রেন্ড আর ফলোয়ার যতো বাড়াতে পারবো ততোই এই জগতে আমার আধিপত্য বা স্ট্যাটাস বাড়বে। এটি আমাদের মধ্যে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রদর্শনবাদীতাই এখানে প্রধান হয়ে ওঠে। এক অপরের সাথে সত্যিকার অর্থে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা নয়।

একে অপরের সাথে চিন্তার আদান-প্রদান নয়! বরং আমাদের মনস্তত্বে কাজ করে- আমার পোস্টে কতো বেশি রেসপন্স হবে সেটি নিয়ে। তার জন্য রেশিও অনুসারে আমরা নেটওয়ার্কের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করি ফেসবুকে। ফেসবুক ব্যবহারকারীর একটি আঙুল স্ক্রলিং করার সময় সবসময়ের জন্য উঠে থাকে। স্ক্রলিং এর সাথে সাথে টিপ মারতে থাকে। লক্ষ্য করেনা কার প্রোফাইলে কি পোস্টে টিপ মারছে! এভাবেই চলছে!

অনেকেই তার পোস্টে কেন লাইক কম পড়ছে এটা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেন। অনেকে ঘোষণা দিয়ে তার প্রোফাইল থেকে বন্ধু ছাটাই করে থাকে। ঘোষণা দিয়ে ছাটাই করতে সে মানসিক তৃপ্তিবোধ করে। কারণ ফেসবুক প্রোফাইল তাকে একধরনের মালিকানা স্বত্বার ফিলিংস দেয়। মধ্যবিত্ত ছাপোষা ঐ ব্যক্তিটির যেহেতু অন্য কোথাও কোন জায়গায় তার মালিকানা নেই, প্রোফাইলের এই মালিকানা সে এনজয় করে। 

অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যবহারকারীর মধ্যে মালিকানাবোধ উসকে দেয়। এবং সেটি কতোটা কদর্য হয়ে ওঠে তাদের প্রোফাইল কেন্দ্রিক আচরণ দেখলেই বোঝা যায়। এটি তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। কারণ তাকে প্রদর্শনবাদীতা গ্রাস করে। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সবকিছুই সে অন্যদের সাথে শেয়ার করতে থাকে। দেখা যাবে বাস্তবে দাম্পত্য জীবনে চরম অশান্তি আর শেয়ার করছে একটি সুখী পরিবারের ছবি! এটা একধরনের নেশার মতো হয়ে ওঠে!

নিজেকে সে মিথ্যা আর মেকি জীবনের অভ্যস্ততায় নিয়ে যায়। এসব করতে যেয়ে নিজের জীবন থেকে সততা আর বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা লোপ পায়। অন্যদিকে যাদের ব্যক্তি জীবনে এই অবস্থা নেই এবং এখনও পর্যন্ত প্রদশর্নবাদীতা গ্রাস করেনি তাদের মধ্যে এসব প্রদর্শন দেখে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয় এটা ভেবে যে অন্যদের ঝলমলে জীবনের মতো তার জীবনটাও ঝলমলে হলো না কেন!

নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে তাকে সন্দিহান করে তুলতে বাধ্য করে। অথবা এই ঝলমলে জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যেনতেন প্রকারে সে তার জীবনের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য প্রভাবিত হয়। ফেসবুক প্রচলনের পূর্বে পরিস্থিতিটা এমন সংক্রামক ছিলোনা। এখন সেটি হয়েছে। 

অনেকেই বলবেন, ফেসবুকের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিকার হচ্ছে, আন্দোলন গড়ে উঠছে। নিশ্চয় কোন কোন সময় সেটি ঘটছে। কিন্তু ফেসবুক প্রচলনের আগেও সেটি ঘটতো। ফেসবুক প্রভাবিত আন্দোলন সবটাই ইস্যুভিত্তিক; যার কারণে ইস্যু শেষ, আন্দোলন শেষ! কেন দিনের পর দিন একই ইস্যু তৈরি হচ্ছে সেই আলাপ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ লুটেরা এই ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখতে চূড়ান্তভাবে সহযোগিতা করছে।

ফেসবুকের এই প্রক্রিয়ার একটি দর্শনগত দৃষ্টিভঙ্গি আছে। বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিই এর চালিকা শক্তি। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশ্বায়ন মানুষের একাকীত্বকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এটির স্বরূপ ফুটে উঠেছে করোনাকালীন সময়ে। বিশ্বায়নের প্রভাব বিস্তারের সাথে ভোগবাদী চাহিদা সৃষ্টি হয় বিশ্বব্যাপী। চাহিদা সৃষ্টি ও পূরণের কৌশল কাজে লাগিয়ে বহুজাতিক কর্পোরেট ও কেন্দ্রীভূত পুঁজি রাষ্ট্র ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পেরেছে। 

যার কারণে পৃথিবীর রাজনীতিটা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। যার মাধ্যমে মানবসমাজের উপর তারা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ে এসে মানুষের তথ্য চাহিদাকে কেন্দ্র করে সেটা জোগান দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে কিছু জায়েন্ট টেক-কোম্পানির তথ্য সাম্রাজ্যবাদ। এদেরই অন্যতম প্রতিভূ ফেসবুক তথা আজকের মেটা। 

পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবনাচরণ পাল্টে দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। আর পাল্টানোর জন্য অপরাপর সাম্রাজ্যবাদী সহযোগীরা পূর্ব থেকেই একটি ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছিলো। মেটা সেটার সুযোগ গ্রহণ করেছে। 

আমার দেশের মানুষের জীবনাচরণকে তারা বেশি মাত্রায় নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছে। কারণ এখানকার শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক শ্রেণী চরিত্র লুটেরা প্রকৃতির। একটি লুটেরা চরিত্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জাতীয় স্বার্থ বা তার দেশের জনগণকে যেকোনো ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা থেকে রক্ষা করার দায় রাষ্ট্র গ্রহণ করেনা। 

বরং সে ইনডিভিজুয়ালিটিকে উৎসাহিত করে। কারণ মানুষ যতো বিচ্ছিন্ন থাকবে, নিজেকে নিয়ে নিজে যতো ব্যস্ত থাকবে তার লুটপাটের বন্দোবস্ত ততটাই নির্বিঘ্ন হবে। লুটেরাদের এই রাজনীতিটা আমাদের বুঝতে হবে। তাদের পাতা ফাঁদ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে। 

লেখক: উন্নয়ন কর্মী

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //