মেধা অনুযায়ী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে

আমাদের শিক্ষার মৌলিক সমস্যা হচ্ছে এখানে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান। ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম এবং মাদ্রাসা- এই তিন শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা ব্রিটিশ আমল থেকেই ছিল, তবে পাকিস্তান আমলে তা আরও বিকাশ লাভ করেছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম বাংলাদেশে এর অবসান ঘটবে। কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং দুঃখজনক ব্যাপার, আমরা এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে পারিনি। 

ধর্মভিত্তিক, কৃত্রিম জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে স্বাভাবিক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমরা এই রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আশা ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে সমস্ত শিক্ষা হবে, শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য থাকলেও মাধ্যম হবে বাংলা ভাষা। এবং কেবল যে আনুষ্ঠানিক অর্থে রাষ্ট্রভাষা হবে তা নয়।

উচ্চ আদালতে এবং শিক্ষার উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বাংলা থাকবে। কিন্তু বাস্তবে সেসব কিছুই হয়নি। বরং আগের তিন ধারার শিক্ষার মধ্যে যে বিভাজন ছিল, তা ক্রমাগত আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। সমস্ত জাতি আজ বিভক্ত। শিক্ষা কোথায় ঐক্য আনবে, তা না হয়ে বরং এই বিভাজনকে আরও বিস্তৃত করেছে। 

আমরা পর্যাপ্ত সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক লিখতে পারিনি। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এখনো নানা রকম বিতর্ক, ভুলভ্রান্তি। হেফাজতের দাবি নিয়ে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করা হচ্ছে। পরীক্ষা নিয়ে চলছে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। শুরু থেকে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রিক, শিক্ষাকেন্দ্রিক না। আমরা পরীক্ষার্থী তৈরি করি, শিক্ষার্থী না। আমাদের আশা ছিল যে, শিক্ষা ক্লাসরুমে হবে। কিন্তু তা না হয়ে শিক্ষা এখন কোচিং সেন্টারে গেছে, কার্ডবুকে গেছে এবং অতিরিক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

এই যে প্রাথমিক পর্যায়ে একটা পরীক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল এটা আবার প্রত্যাহার করা হলো তার কারণ আমরা বুঝলাম না। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত এখন পরীক্ষা নাই। পিএসসি নাই, জিএসসি নাই। কিন্তু কেন ঢুকানো হয়েছিল, কেনই বা প্রত্যাহার করা হলো- কোনো যুক্তি নাই। পরীক্ষা নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার তো দরকার নেই। এই যে বাংলা মাধ্যমের পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন করা হচ্ছে, ইংরেজি মাধ্যমের বইগুলোতে কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসছে না। আবার ওইদিকে মাদ্রাসার বইগুলোতেও কোনো পরিবর্তন করা হচ্ছে না। গোটা চাপটা পড়ছে মধ্যবিত্তের যে শিক্ষাব্যবস্থা বাংলা, তার উপরে। সেজন্য এই শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতাটা রয়ে গেল। 

একদিকে তিন ধারা, আরেকদিকে পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা। আর অন্যদিকে বড় আরেকটা সমস্যা- সেটা হচ্ছে শিক্ষার জন্য যদি আমরা চেষ্টা করি বা শিক্ষার মান উন্নত করতে চাই তাহলে উপযুক্ত শিক্ষক লাগবে। উপযুক্ত শিক্ষক ছাড়া উন্নতমানের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব না। উপযুক্ত শিক্ষক যদি আনতে হয় তাহলে মেধাবীদের আনতে হবে। তাদের বেতন-ভাতা দিতে হবে। সম্মান করতে হবে, যে সম্মান এখন আমাদের সমাজে নেই। আগে ছিল; এখন শিক্ষকরা সম্মানিত প্রাণী নন। সম্মান হচ্ছে টাকাওয়ালাদের, সম্মান হচ্ছে আমলাদের, সম্মান হচ্ছে যারা ব্যবসায়ী তাদের, ধনীদের। 

কাজেই শিক্ষাকে কেন মূল্যবান করতে পারছি না? কারণ শিক্ষা পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। ক্রয়-বিক্রয়ে পরিণত হয়েছে। এটা যে ভেতর থেকে আগ্রহের ব্যাপার হবে সেটা হচ্ছে না। 

আরও একটা বিষয় লক্ষ করতে হবে, শিক্ষার সঙ্গে কর্মের যে সংস্থান তার যোগাযোগ ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। ধরা যাক আগেকার দিনের একজন শিক্ষিত লোক এমএ পাস। সে একটা না একটা চাকরি পাবে বলে ধরে নিতে পারত। এখন সে নিশ্চয়তা নাই। এখন যেহেতু জীবিকার নিশ্চয়তা শিক্ষা দিচ্ছে না, তাই শিক্ষার জন্য আগ্রহটাই কমে গেছে। তারপরও পড়ে, পড়ার জন্য পড়ছে। কিন্তু আগ্রহ নিয়ে পড়ছে না। 

আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষা শুধু দিলে হবে না। শিক্ষা যাতে শিক্ষার্থী গ্রহণ করতে পারে তার সেই যোগ্যতা তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ তার মধ্যে যে সাংস্কৃতিক চেতনা আছে, যে জীবন আছে সেটাকে উজ্জীবিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো কোনো কারখানা না; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক জীবন চাই। সামাজিক জীবন চাই এবং সেজন্য খেলাধুলা চাই।

ওইগুলো তো আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাখছি না। শুরু থেকেই ছাত্র সংসদ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অপরিহার্য অংশ ছিল। কিন্তু গত ত্রিশ বছরে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো ছাত্র সংসদ নেই। ছাত্র সংসদ ছিল আমাদের শিক্ষা জীবনে উৎসবের মতো, বার্ষিক উৎসব। সেখান থেকে নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে। মেধাবানরা বেরিয়ে আসে।

তারাই নির্বাচিত হন, যারা মেধাবান। এবং তারা তখন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা রকম অবদান রাখে। খেলাধুলায় অবদান রাখে, লেখে, বক্তৃতা করে, গান করে, আবৃত্তি করতে পারে। তারা নাটক লিখতে পারে, অভিনয় করতে পারে এবং তাদের পড়াশোনাও হয় ভালো। চৌকস যারা কেবল তারাই নির্বাচিত হতো এবং তাদেরকেই অন্য ছেলেমেয়েরা আদর্শ বলে মনে করত। 

এখন এসব হয় না। এখন ক্ষমতা চলে গেছে সরকারি দলের যে সংগঠন তার হাতে। কাজেই সাংস্কৃতিক জীবনটা নাই। আমাদের কাছে ভয়াবহ লাগে যে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অনেকটা শিক্ষিত মানুষের বস্তিতে পরিণত হচ্ছে।

বস্তিতে যে ধরনের কলহ থাকে, সংঘর্ষ থাকে, দখলদারিত্ব থাকে সেগুলো সব এই শিক্ষিত লোকদের যে আবাস বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসছে। কাজেই এগুলোর মৌলিক পরিবর্তন দরকার। অবশ্য এটা সংস্কারের ব্যাপার নয়। এবং সংস্কারমূলক যে শিক্ষা কমিশনগুলো হয়েছে সেগুলোর কোনোটাই কার্যকর হয়নি। 

আমাদের আরেকটা সমস্যা হলো গবেষণা হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে বলতে হবে যে গবেষণাকে উৎসাহিত করা হয় না বা মূল্য দেওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান বিতরণ করে। জ্ঞান বিতরণ করতে হলে জ্ঞান সৃষ্টি করতে হয়, জ্ঞান সংগ্রহ করতে হয়। সেটা হচ্ছে না। 

আরেকটা জিনিস হচ্ছে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে বাংলা ভাষায় নিয়ে আসার জন্য যে অনুবাদ করার দরকার ছিল, সেটা আমরা করতে পারিনি। যে কারণে আমাদের লাইব্রেরিগুলোতে শতকরা পঁচানব্বইটা বই ইংরেজি ভাষায় লেখা। কিন্তু সেগুলো তো সাধারণ ছেলেমেয়েরা পড়তে পারছে না। এর অর্থ, শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না এবং জিডিপির কমপক্ষে দুই শতাংশ এখানে বিনিয়োগ করা উচিত, যা হচ্ছে না। 

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য হচ্ছে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন এবং এই দুটোকেই গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো- দুটো ক্ষেত্রই এখন ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনার ব্যাপার হয়ে গেছে, যেখানে বিনিয়োগ করতে হয়। যার সুযোগ আছে সেই যেন শিক্ষার সবচেয়ে বড় সুযোগগুলো পাবে। আর এদিকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ঝরে পড়ছে।

একদিকে মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে, তারা খুব ভালো ফল করছে। আরেকদিকে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছে। শিক্ষকদের দ্বারা যৌন হয়রানির কথা আমরা আগে কখনো শুনতাম না, এখন যা প্রয়ই শোনা যায়। দ্বিতীয়ত বাবা-মা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারে না।

মনে করতে হবে যে শিক্ষা একটা অধিকার। শিক্ষা কোনো পণ্য বা সুযোগ নয়। আমি যেহেতু নাগরিক, কাজেই আমার অধিকার আছে শিক্ষা পাওয়ার। সকলে যে একধরনের শিক্ষা পাবে তা না। কিন্তু সকলের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত থাকতে হবে, সুযোগ থাকতে হবে এবং যার যেটা প্রাপ্য সেটা তাকে দিতে হবে। তা না পাওয়াটাই হচ্ছে শিক্ষার সমস্যা। 

কাজেই সমস্ত জিনিসটা আমি এভাবে দেখব যে আজকে সমাজে মৌলিক পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়েছে। আমরা সেই সমাজ চাইব, যে মানুষের এই চাহিদাগুলো মেটাবে। অর্থাৎ যে সমাজ পরিপূর্ণ অর্থে গণতান্ত্রিক হবে। পরিপূর্ণ অর্থে গণতান্ত্রিক বলতে আমি কী বুঝি? সেখানে অধিকার এবং সুযোগের সাম্য থাকবে। সকলেই যে সমান হয়ে যাবে তা না, সেটা আমি বলছিও না।

তবে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং অধিকার থাকতে হবে। অধিকার কেবল লিখিত হলে হবে না। অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্র থাকতে হবে এবং সুযোগ থাকতে হবে। মেধা অনুযায়ী সুযোগ এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে এবং ক্ষমতার সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা থাকবে। জবাবদিহিতাহীন কোনো সমাজ কখনো গণতান্ত্রিক হতে পারে না।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাবি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //