রাজাকারের তালিকায় কাদের নাম থাকবে

আগামী ২০২৪ সালের মার্চে রাজাকারের তালিকা প্রকাশের কথা জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর বাগমারায় নবনির্মিত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন; রাজাকার, আল শামস বা জামায়াতে ইসলামী যারা ঘোষণা দিয়ে সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাদের তালিকা প্রকাশের জন্য নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত এটি চলবে। আগামী বছরের মার্চ মাসে এটি প্রকাশিত হবে।’ (প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।

স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির পথ উন্মুক্ত করতে গত বছরের ২৯ আগস্ট সংসদে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বিল-২০২২’ বিল পাস হয়। যদিও এর আগে থেকেই জাতীয় সংসদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি উপ-কমিটি এ বিষয়ে কাজ করছে। সংসদীয় কমিটি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার রাজাকারের তালিকা পেয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’সহ রাজাকারের তথ্য সংগ্রহে জড়িত কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করছে সংসদীয় কমিটি। তবে শোনা যাচ্ছে, রাজাকারের আংশিক তালিকা প্রকাশ করা হলে সমালোচনা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় এখন আংশিক নাকি পূর্ণাঙ্গ তালিকা হবে, এ নিয়ে সরকারের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। (বাংলা ট্রিবিউন, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২)। 

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে বীর মুক্তিযোদ্ধার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে সেখানেই স্বাধীনতাবিরোধীদের পরিচয় স্পষ্ট করা আছে। আইনে বলা হয়েছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া যাঁহারা দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিয়াছেন এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিস কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছেন।’ 

আইনে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কার্যাবলির (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাহারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিস কমিটির সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থাকিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করিয়াছে বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিরীহ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করিয়াছে অথবা একক বা যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে প্রত্যক্ষভাবে, সক্রিয়ভাবে বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করিয়াছে তাহাদের বিদ্যমান তালিকা প্রকাশের পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে ও প্রয়োজনে, যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে নূতন তালিকা প্রকাশের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিবে।’ 

তার মানে আইনে স্পষ্ট করে ‘যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে নতুন তালিকা’ প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। মূল চ্যালেঞ্জটা এখানেই। অর্থাৎ কারও বিরুদ্ধে যদি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা বা কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকে, তাহলে তার নাম প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু ২০১৯ সালে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ নিয়ে কী হয়েছিল, তা দেশবাসীর মনে আছে। সুতরাং সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোই হবে রাজাকারসহ অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধীদের তাালিকা প্রকাশের মূল চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য।

এজন্য আইন হয়েছে। কিন্তু ওই আইনের আলোকে বিধিমালা এবং নীতিমালায় এটি পরিষ্কার থাকতে হবে যে, কোন কোন শর্ত মেনে তালিকাটি প্রকাশ করা হবে। কাদের নাম তালিকায় আসবে। 

তালিকা প্রণয়নকারীদের ভুল বা পক্ষপাত বা অন্যায়, ডিজিটাল মিসটেক, নামের বানান বিভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে যদি এমন কারও নাম ওই তাালিকায় ঢুকে যায়, যার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা কিংবা ১৯৭১ সালে সুস্পষ্ট কোনো অপরাধের প্রমাণ নেই, তার আইনি প্রতিকার কী হবে? 

কেউ যদি এই তালিকা প্রকাশে সংক্ষুব্ধ হন, তিনি কি উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন? সংক্ষুব্ধ সবার পক্ষে উচ্চ আদালতে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাদের পক্ষে রাষ্ট্র কীভাবে দাঁড়াবে? কারও নাম একবার তালিকায় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি এবং তার পরিবার যে সামাজিকভাবে সম্মানহানির শিকার হবেন, সেই যন্ত্রণার কথাটিও রাষ্ট্রকে বিবেচনায় রাখতে হবে। 

তবে রাজাকারের তালিকা প্রকাশের জন্য বিধিমালা প্রয়োজন হবে না বলে মনে করেন জাতীয় সংসদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান। তার মতে, যেহেতু আইন হয়েছে, সেহেতু নীতিমালার দরকার নেই। (বাংলা ট্রিবিউন, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২)। 

অবশ্য মূল প্রশ্নটি স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রকাশের পর কী হবে? ২০১৯ সালে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি হবে নাকি এমন কোনো সংকট তৈরি হবে, যা কেউ এখন ভাবছেই না? যখন এই তালিকাটি প্রকাশ করা হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন, অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চে, তার মাস তিনেক আগেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা এবং ততদিনে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে নেবে।

যদি ওই নির্বাচনটি আগের দুটি নির্বাচনের মতোই প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি ওই নির্বাচনের ফল মেনে না নিয়ে রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখে, যদি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করার জন্য সরকার আন্তর্জাতিক চাপে থাকে, এরকম অবস্থায় এ ধরনের একটি তালিকা প্রকাশ করে সরকার ওই পরিস্থিতিকে কি আরও জটিল করবে?

আবার যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের সুযোগ পায় এবং রাজপথ ও রাজনীতির মাঠ যদি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন এই তালিকাটি প্রকাশ করা হলেও ২০১৯ সালের মতো পরিস্থিতি এড়াতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কি প্রস্তুত? মাঠ পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত তালিকা তৈরি ও প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কতটা দলনিরপেক্ষ, সৎ ও আন্তরিকভাবে কাজটা করছেন বা করতে পারছেন, সেটিই এই মুহূর্তের সবচয়ে বড় প্রশ্ন।

বড় কথা হলো, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে ইতিমধ্যে অনেক শীর্ষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ নানা মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যাদের নাম আগে থেকেই দেশবাসী জানত, তাদের বাইরে অপরিচিত বা যাদের বিরুদ্ধে বড় কোনো অপরাধের তথ্যপ্রমাণ নেই বা এত বছর পর তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করাও বেশ কঠিন এবং দেশটা যেখানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজনীতিতে বিভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং এই জাতীয় তালিকাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা যেহেতু খুবই কঠিন, সেরকম বাস্তবতায় এত বছর পর এই তালিকাটি প্রকাশ করে সরকার কেন নতুন করে এমন একটি ইস্যু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে তুলে দিতে চায়, যেটি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হওয়ার শঙ্কা রয়েছে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //