জাতীয় পুরস্কার নিয়ে কেন বিতর্ক

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রথম বিতর্কিত হয় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে। তৎকালীন ছারছীনা পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ, যিনি ছিলেন পিস কমিটির প্রথম চেয়ারম্যান এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডিসেম্বরেই যিনি গ্রেপ্তার হন, তাকে ১৯৮০ সালে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। 

জিয়াউর রহমান- যিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ‘বীর উত্তম’ খেতাব পেয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যার স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে সৈনিকদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল, তিনি কী করে এমন একজনকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারে ভূষিত করলেন, যাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেই প্রশ্ন এখনো আছে। কিন্তু ২০২১ সালে জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হলেও ছারছীনা পীরের স্বাধীনতা পুরস্কার এখনো বহাল। পরবর্তী কোনো সরকারও ওই পুরস্কার প্রত্যাহার করার সাহস করেনি।

স্বাধীনতা পুরস্কার যেহেতু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, অতএব এটি কাকে দেওয়া হলো এবং কোন যুক্তিতে- সেটি দেশের মানুষের জানার অধিকার রয়েছে। সুতরাং ১৯৮০ সালে কোন কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ছারছীনার পীরকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, সেটি রাষ্ট্রীয়ভাবে জানানো দরকার। যেহেতু পরবর্তী সময়ে কোনো সরকার সেটি প্রত্যাহার করেনি, তার মানে রাষ্ট্র মনে করে ওই পুরস্কারটি যৌক্তিক। সেই যুক্তিটা মানুষকে জানানো দরকার। 

দুঃখজনক ব্যাপার হলো প্রতিবছরই স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে কমবেশি বিতর্ক হয়, সমালোচনা হয়। বিশেষ করে দেশে সোশ্যাল মিডিয়া বিকশিত হওয়ার পর জাতীয় পুরস্কারগুলো নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান।  

কারণ আগে সমালোচনা হলেও সেগুলো নির্দিষ্ট কিছু পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকত। এখন সবাই নিজের মতো করে এ বিষয়ে মতামত দিয়ে থাকেন। যে আলোচনায় সঙ্গত কারণে ব্যক্তির রাজনৈতিক বিশ্বাস ও অবস্থানও কমবেশি ভূমিকা রাখে। এবারও বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে, সেখানে অনেকেই লিখেছেন, যারা বিভিন্ন শাখায় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন, তাদের অনেকেই লেখক হিসেবে একেবারেই অপরিচিত বা নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাসের অনুসারী হওয়ায় তাদেরকে মনোনীত করা হয়েছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেটি বিরল। ওই বছর যাদেরকে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয় তাদের মধ্যে আমির হামজা নামে একজন ছিলেন; যার এই পুরস্কার পাওয়া যোগ্যতা নেই বলে দারুণ সমালোচনা হয় এবং ওই সমালোচনার মুখে সরকার তার নামটি বাতিল করে। প্রশ্ন হলো, কারা নামটি দিয়েছিলেন এবং চ‚ড়ান্ত মনোনয়ন দিলেন? এর আগে ২০২০ সালেও সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের নাম ঘোষণার পরে তীব্র সমালোচনার মুখে সরকার সেই নামটিও প্রত্যাহার করে। 

তখন যেটি আলোচনাটি ছিল তা হলো, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একজন জীবিত অথবা মৃত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং সেই সম্মান নানাভাবেই দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যে শাখায় পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে সাহিত্য, চিকিৎসা, স্থাপত্য ইত্যাদি- বিশেষায়িত শাখায় কাউকে পুরস্কৃত করতে হলে এসব ক্ষেত্রে তার বিশেষ অবদান থাকতে হয়।

প্রশ্ন ওঠে, সরকার ২০২০ সালের ওই ঘটনা থেকে কি কোনো শিক্ষা নেয়নি? যদি ২০২২ সালেও শিক্ষা না নিয়ে থাকে, তাহলে ধরে নেওয়া যায় ২০২৩ সালেও  বিতর্ক হবে।

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। একুশে পদকের দায়িত্ব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। আর বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয় বাংলা একাডেমি। তিনটি পুরস্কারেই যে আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির প্রভাব রয়েছে, সেটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে সব আমলে বা বছর যে এরকম হয়েছে তা নয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। তবে সাহিত্যের যে শাখায় যাকেই পুরস্কার দেওয়া হোক না কেন, প্রথমত লেখার কনটেন্ট ও মান বিবেচনায় নিয়ে তারপর রাজনৈতিক বিবেচনাটি থাকলে ভালো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে প্রবণতাটি দেখা যাচ্ছে তা হলো, আগে রাজনৈতিক বিবেচনা, তারপর কনটেন্ট। এটা খুব ভয়ঙ্কর, ক্ষতিকর। 

এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে নতুন কোনো অনুসন্ধান বা বিশ্লেষণ থাকে না। সেসব লেখার মূল উদ্দেশ্য একটি পক্ষের সন্তুষ্টি অর্জন বা খুশি করা। এভাবে সাহিত্য বা গবেষণা হয় কি না- সেটিই বড় প্রশ্ন।

১৯৯১ সালে দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত যারা বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন সেখানে দেখা যাচ্ছে- ১৯৯২ সালে মুনতাসীর মামুন, ১৯৯৫ সালে শাহরিয়ার কবির, ২০০৪ সালে মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ফরিদুর রেজা সাগর সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন, যারা বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত নন। তার মানে নিরপেক্ষ বিচারেই তারা পুরস্কার পেয়েছেন। ওই বছরগুলোয় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। আবার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত অর্থাৎ যে সময়টায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তখনো যারা পুরস্কৃত হয়েছেন, তাদের সবাই যে আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক এমনও নয়। 

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লেখকের লেখা বা সৃষ্টিকর্মের চেয়ে তার রাজনৈতিক বিশ্বাস, আনুগত্য ও যোগাযোগ পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে পুরস্কারগুলো নিয়ে বিতর্ক হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ ট্রল করে, সমালোচনা করে। ফলে যারা প্রকৃতই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য এবং পুরস্কৃত হন, তাদের জন্যও বিষয়গুলো বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়।

এক্ষেত্রে একটা বিষয় অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন প্রতিবছর যারা সাহিত্যের নানা শাখায় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, তাদেরকে কেন এবং কোন কোন মানদণ্ড বিবেচনায়, কোন কোন গ্রন্থের জন্য কেন মনোনীত করা হলো- সে বিষয়ে বাংলা একাডেমি একটি লিখিত বিবৃতি দিতে পারে, যেটি পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। তখন ওই বইগুলো সংগ্রহ করে পাঠকরা পড়ে বুঝতে পারবেন যে, তাদেরকে কেন পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলো।

যারা পুরস্কার পাননি তাদের সঙ্গেও ওই পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের লেখার তুলনা করার সুযোগ তৈরি হবে। কারণ যে বাংলা একাডেমিকে বলা হয় জাতির মেধা ও মননের প্রতীক, তাদের প্রতিটি কাজ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকা উচিত। কারণ পুরস্কারটি দেওয়া হয় জনগণের টাকায়। সেই টাকা একাডেমি কাকে দিচ্ছে এবং কেন দিচ্ছে, সেটি জানার অধিকার তাদের থাকা উচিত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //