পেছন ফিরে দেখা আর সামনে তাকানো

বছরটা চলেই গেল। কত সমারোহে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আতশবাজির ঝলকানির মধ্য দিয়ে এসেছিল আর প্রায় নীরবেই চলে যাচ্ছে। তবে প্রস্থানটা নীরবে হলেও অবস্থান কিন্তু উত্তেজনাময় ছিল। সারা বছর ছিল রাজনৈতিক উত্তেজনা- শাসক দলের নিপীড়ন আর বিরোধীদের আন্দোলন নিয়ে।

এর সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানো, সারসহ কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি চলেছে সমান তালে। শাসক দলের পক্ষ থেকে সাফাই গাওয়া হয়েছে যে, দাম বাড়লেও আমরা ভালো আছি ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে, একজন তো উত্তেজনায় বলেই ফেললেন- ওদের সঙ্গে তুলনা করলে মনে হবে আমরা বেহেশতে আছি।

এ কথা শুনে অনেকে দোজখের উত্তাপ অনুভব করলেও জান ও মান বাঁচাতে চুপ করে থাকাই নিরাপদ ভেবেছেন। সর্বশেষ বিরোধী দলের ঢাকা সমাবেশ, ক্ষমতাসীনদের নানা বাধা-বিপত্তি, ২৭ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচি এবং আওয়ামী লীগের সম্মেলন দিয়েই বছরটা শেষ হবে। 

শুধু এই বছর নয়, অতীত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে শুধু স্মৃতিচারণ নয়, স্বপ্নের পরিভ্রমণও ঘটে। আমাদের দেশের জীবনে তেমনি একটা দিন বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ ইশতেহার ঘোষণা, ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্সের ঘোষণা, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠন, ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ আর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, এক বছরেই এতগুলো অর্জন। স্বাধীনতা দিবস থেকে বিজয় দিবস ২৬৬ দিনের এক অবিস্মরণীয় যাত্রা। রক্তে ভেজা ভূখণ্ড, একটি পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত আর এক বুক স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু বাংলাদেশের।

আকাশচুম্বী আশা নিয়ে, সাগর পরিমাণ রক্ত দিয়ে, প্রতিজ্ঞা আর সাহসে ভর করে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। কাঁধে রাইফেল, মুখে বিজয়ের উল্লাস নিয়ে আর সবুজের বুকে লাল বৃত্ত আঁকা পতাকা উড়িয়ে যখন তারা দেশে মার্চ করছিল তখন সন্তানহারা মা তার হাহাকার ভুলে গিয়েছিল আর সম্ভ্রমহারা বোনটি মাথা উঁচু করে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছিল। ভেবেছিল সবাই, এবার দেশটা আমাদের হবে। 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, সময়ের হিসাবে পার হয়ে গেছে ৫১ বছর, কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিনের কথা! এই ৫১ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়, বরং অনেকেই বলছেন বিস্ময়কর। যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতির চিত্র দেখি তাহলে দেখব, মাথাপিছু আয় ১১০ ডলার থেকে বেড়ে এখন ২৮২৪ ডলার, জিডিপি ৯ বিলিয়ন থেকে হয়েছে ৩৯৭ বিলিয়ন ডলার, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। খাদ্য উৎপাদন ১ কোটি ১০ লাখ টন থেকে বেড়ে ৫ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়াও সেতু, হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল আর মেট্রোরেল অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে দৃশ্যমান করেছে। 

স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের পূর্বসূরিরা তাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের ভবিষ্যতের জন্য। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে একটা জাতিকে যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল তার নজির পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ৩০ লাখ মানুষের জীবন দান, ২ লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রম, কোটি মানুষের গৃহহারা হয়ে দেশান্তরী হওয়া, গোটা দেশটাই একটা নির্যাতন ক্যাম্পে পরিণত হওয়ার ঘটনা যেমন বিশ্ববাসী জানে, তেমনি জানে কী অপরিসীম সাহস ও দেশপ্রেমের বলে বলীয়ান হয়ে মাত্র ৮/১০/১২ সপ্তাহ ট্রেনিং নিয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিল বাংলার দামাল ছেলে-মেয়েরা। 

এই অসম লড়াইয়ে সাহসের উৎস কী ছিল? ছিল দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মুক্তি অর্জন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আকুতি। প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনে এই ভূখণ্ডের মানুষ বুকে পরাধীনতার গ্লানি আর চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রাম করেছে।

ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবোধ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল, কিন্তু তা পরিণত রূপ পায়নি নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব ও ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে। দ্বিজাতি তত্ত্বের নামে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার যে বীজ বপন করা হয় তার ফলে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠে পাকিস্তান। পৃথিবীর কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ হয়নি।

যদি তা হতো তাহলে এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সব কটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল মিলে একটি মুসলিম দেশ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। ইউরোপের সবগুলো দেশ মিলে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের দেশ হয়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া মিলে যেমন বৌদ্ধ ধর্মের দেশ হয়নি, তেমনি ভারত নেপাল মিলে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের দেশ হয়নি।

কারণ দেশ হতে গেলে ভূখণ্ডগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক বন্ধন, ভাষা, অর্থনৈতিক জীবনধারা প্রভৃতি দরকার হয়। যে কারণে এক ধর্মের মানুষ হলেও তাদেরকে নিয়ে এক দেশ হয় না। তাই হাজার মাইলের ভৌগোলিক দূরত্ব, ভাষা সংস্কৃতির পার্থক্য নিয়ে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামের যে দেশ গড়ে তোলা হয়েছিল তা কোনো বিচারেই এক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল না। 

এই কৃত্রিম রাষ্ট্র ঐক্য প্রতিষ্ঠার নামে যেসব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিল তাতে মোহ ভঙ্গ হতে বেশি দেরি লাগেনি। ভাষার উপর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ৫২ সালে, শিক্ষার অধিকার সংকুচিত করার প্রতিবাদে ৬২ সালে, সংস্কৃতির উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে ৬৫ সালে, ৬ দফার লড়াইয়ে ৬৬ সালে, সামরিক শাসক আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ৬৯ সালে, মানুষের বিপুল অংশগ্রহণে নির্বাচনে ধস নামানো বিজয় ৭০ সালে এবং এর ধারাবাহিকতায় ৭১-এর সশস্ত্র লড়াই আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।

পাকিস্তান ছিল একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র তার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা, পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসন দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র তার বিপরীতে গনতন্ত্র, ব্রিটিশ শোষণ ও পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে সমাজতন্ত্র আর দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি প্রায় ঔপনিবেশিক শাসনের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ, এই আকাঙ্ক্ষাগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের চেতনায়।

তাই ঘোষণা করা হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে গ্রাম শহরের শ্রমজীবী মানুষ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মধ্যবিত্ত নেমে এসেছিল আন্দোলন, অভ্যুত্থান আর স্বাধীনতার লড়াইয়ে। সব পথ যেন মিশে গিয়েছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, স্বাধীনতার মোহনায়। 

কিন্তু ৫১ বছর পর আকাঙ্ক্ষা আর প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গেলে দেখা যাবে অনতিক্রম্য এক বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে । শুধু তাই নয়, মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক সুউচ্চ দেয়াল। স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল যারা আর সুফল ভোগ করছে যারা তারা একদেশের মানুষ হয়েও যেন এক জাতের নয়।

একদেশে অর্থনৈতিকভাবে দুই জনগোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেল যাদের স্বপ্ন, শিক্ষা এমনকি ভাষাও আলাদা হয়ে গেছে দিনে দিনে। কেউ অভাবের চাপে বিদেশে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে টাকা পাঠায় দেশে আবার কেউ দেশে লুটপাট করে টাকা পাচার করে বিদেশে। বন্যা, খরা, ঝড় বেশিরভাগ মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন করে দেয়, আবার কারও জন্য মুনাফার সুযোগ অবারিত করে দেয়।

তাই তো ২ জন কোটিপতি নিয়ে যে দেশের যাত্রা শুরু সে দেশে এখন সোয়া লাখের বেশি কোটিপতি আর ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচেই থেকে গেছে। যেখানে বলা হচ্ছে মাথাপিছু আয় ২৮২৪ ডলার, সেখানে দেশের শ্রমজীবীদের ১৫০০ ডলার রোজগার করাই কঠিন। এই টাকা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগ করা হলে কত দাঁড়াবে? গণতন্ত্র এবং নির্বাচন যেন সুদূরের স্বপ্ন হয়েই রইল। মানবিক মর্যাদা যেন বেদনাময় আকুতি, ন্যায়বিচার যেন দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত। স্বাধীনতার পর দেশের বয়স যত বেড়েছে স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো যেন তত দূরে সরে গিয়েছে। 

নতুন বছর আসবে নতুন উত্তেজনা নিয়ে তবে সঙ্গে থাকবে পুরনো বেদনা আর পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ। ২০২৩ সাল হবে রাজনীতির এক ঝঞ্ঝামুখর বছর। এই ঝড়ের কবলে পড়ে যেন শ্রমিকের মজুরি, কৃষকের ফসলের দাম, ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা, যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থান, নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার স্বস্তি আর দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতের কথা আমরা ভুলে না যাই। 

সহ-সাধারণ সম্পাদক
বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //