‘তুই অপরাধী’ গান আর আর্জেন্টিনা এত জনপ্রিয় কেন

মানুষ ভালোবাসতে ও ঘৃণা করতে পছন্দ করে। প্রেম করতে ও বিরহ দুইটাতেই আসক্ত কিনা জানি না তবে এটা তাকে ধাক্কা দেয়, টানে। গান শুনে বিরহ সামলে কাতরতা কমায় কিছু মানুষের জন্য। মানব সমাজের আদি ভাবনাগুলো আমাদের মাথায় এখনো সজীব।

বিষয়টা বেশ দার্শনিক কিসিমের। কী অসম্ভব জনপ্রিয় এই ফুটবলের দেশ আর কী ভীষণ জনপ্রিয় এই গান। কিন্তু এত জনপ্রিয় কেন সেটা কি বোঝার উপায় আছে? নাকি আমরা যে জানি না কেন জনপ্রিয় সেটাই আসল মজা?

দুই.

একজন গবেষক হিসেবে আমাকে সংখ্যা নিয়ে মাঝেমধ্যে কাজ করতে হয়। তাতে সামাজিক জনপ্রিয়তা একটা বিষয় হিসেবে আলোচনা হয় ক্লাসে। এর উদ্দেশ্য হয়েছে সেই সব সূচক উদ্ধার করা যাতে করে আমরা বুঝতে পারি কেন কিছু জনপ্রিয় হয়। এটা কাজে লাগে সামাজিক বা পণ্য মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে। এবারও আমরা একটা জরিপ করি সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ও দলের ওপর। এতে জানা যায় দেশের ৬০% আর্জেন্টিনার ভক্ত, ৩০% ব্রাজিল আর ১০% অন্য দেশের। কেন?

আরমান আলিফের গান ‘তুই অপরাধী’র ভিউ হচ্ছে ৩৫০ মিলিয়ন বা ৩৫ কোটি। আর একটা গান ‘নেশা’র ভিউ হচ্ছে ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি। 

আজ পর্যন্ত যত বাংলা গান ভিউ হয়েছে তার মধ্যে ‘অপরাধী’ সবচেয়ে বেশি শ্রুত ইউটিউবে আর ‘নেশা’ টপ পাঁচ। জাতীয় সংগীত বাদ দিলে এমনি অন্য কোনো গান কম্পিটিশন করে জিততে পারবে না। এটা কেবল বাংলাদেশের গান নয়, ইন্ডিয়ান বাঙালিদের কাছেও জনপ্রিয়। নেশাও তেমনি। কিন্তু আবার সেই প্রশ্ন। কেন?

তিন.

বছর চারেক আগে ‘অপরাধী’ গানটির জন্ম। শুরু থেকেই আগ্রহ তৈরি হয় এবং একাধিক ব্যান্ড ও সিঙ্গার এটা কাভার করেন। তারপর একসময় জনকল্পনায় স্থান পায়, তারপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি ‘অপরাধী’ ও ‘নেশা’। আরও কয়েকটি গান তাদের একটি কিংবদন্তি সাইজের অবস্থানে নিয়ে গেছে। তবে সম্রাট হচ্ছে ‘তুই অপরাধী’। অন্য লেভেলের পপুলারিটি। গানটার সুর কেমন? সুন্দর, সহজ। গানটার লিরিক্স/কথা কেমন? আরও ভালো। আর ভিডিও? বুকে কষ্ট দেয়। সব মিলে একাকার। এই কথাগুলা এসেছে জরিপে।

চার.

সবই তো ভালো কথা। কিন্তু অনেক সুরেলা গান, সুন্দর লিরিক্স নিয়ে গান আছে কিন্তু এমন হিট হয় না। ভিডিও তো এরকম আছে অন্য গানে। কিন্তু সবাই বলেছে মিক্স বা মিশেলটা খুব ভালো। আর বিষয়? ওটা সবার জানা। একটু মুচকি হেসে বা একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছে: ‘ছ্যাঁকা’ও ধরা যেতে পারে, এই গান: ছ্যাঁকা বিষয়ক জাতীয় সংগীত। যত বাঙালি ছ্যাঁকা খেয়েছে তারা বোধহয় সবাই গানটা শুনেছে। খায়নি যারা তারাও শুনেছে। গানের বিষয় হিসেবে ছ্যাঁকা লা জওয়াব। রবি, নজরুল বাবু দুইজনই এই কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। নিজেরা জীবনেও তারা বেশ কিছু ছ্যাঁকা খেয়েছেন। নিশ্চয় দিয়েছেন। নজরুল তো নার্গিসকে পুঁজি করে অনেক দূর এগিয়েছেন। আর রবীন্দ্র বাবু ‘হায় ছবি হায় ছবি’ করে বাঙালির মনে স্থায়ী আসন গেড়েছেন। বাঙালিরা বড় ছ্যাঁকা প্রিয় জাতি। না খেলেও দুধের স্বাদ গানের ঘোলে মেটাতে চায়। আমার এক দোস্ত যেমন একবার বলেছিলেন, ‘বন্ধু, বিরহ বেদনা বড় মধুর।’ 

পাঁচ.

গবেষণায় আরও পাওয়া গেল যে ‘তুই অপরাধী’র লিরিক্সের স্টাইল মনের খুব কাছের, দাগ কাটে। মেয়ে না বলে ‘মাইয়া’, সুশীল ‘তুমির’  বদলে ‘তুই’ বলাতে সবার অনেক নিকটের মনে হয়েছে। কমিউনিকেশন সায়েন্স জগতে যেটা বলি ‘একাত্মতা’ সেটা এই গান দিয়েছে। এমনকি সবচেয়ে বেশি ‘অপছন্দ’ বাটন চাপ পড়েছে এই ‘অপরাধী’ গানে। এটা তো তাহলে পরিষ্কার যে মানুষকে, এই গান নাড়া দিয়েছে, যেভাবেই হোক। ছ্যাঁকা+পাবলিকের ভাষা+পাবলিকের ভিজ্যুয়াল+সহজ সরল সুর সব মিলে ব্যাপারটা ঐতিহাসিক হয়ে গেছে। 

ছয়.

কিন্তু আর্জেন্টিনা কেন এত জনপ্রিয়? ব্রাজিল জনপ্রিয় কিন্তু ‘আরজু’ বেশ এগিয়ে। কিন্তু এত দেশ থাকতে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কেন? বিলেত নয় কেন যাদের ক্লাবগুলোর অনেক ভক্ত রয়েছে বাংলাদেশে? জরিপে বলছে ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা আর দেশের প্রতি ভালোবাসা এক নয়। ক্লাব-প্রেম ফুটবল ভক্তদের বিষয় কিন্তু ‘দেশ-প্রেম’ সবার বিষয়। আর ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা ল্যাটিন দেশ। তার সাথে মেলে মানুষের মনের সাথে। সবার ধারণা এরা ইউরোপীয় নয়, যদিও দুই দেশই স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক জনগোষ্ঠীর দেশ। সোজা কথায় দূরের নয় কাছের দেশ।

সাত. 

ব্যক্তির ভূমিকাও আছে। ব্রাজিলের পেলের নাম নয়া প্রজন্মের অনেকেই জানে না। কিন্তু ম্যারাডোনা সাম্প্রতিক কালের মানুষ। তার খেলা অনেকেই দেখেছে নিজ চোখে, ভিডিও আর্কাইভ তো আছেই। তবে আর একটা কারণ বেশ অন্যরকম। বন্ধু-পাড়া-পারিবারিক পর্যায়ে অনেকের সমর্থন দেয়া ‘ওদের টিম’  আর ‘আমাদের টিম’ ভাবনা কাজ করেছে। মানে অপছন্দের মানুষের দল অনেকেই সমর্থন করে না। তবে বিএনপির দল, আওয়ামী লীগের দল এমন তকমার উল্লেখ পাইনি। আর নিজের দলকে ভালোবাসা মানে অন্য দল ও সমর্থকদেরকে অপছন্দ করা থেকে ঘৃণা করা পর্যন্ত যায়। এমনি এমনি মানুষের মারামারি থেকে খুন-জখম পর্যন্ত যায়নি। নৃতত্ত্বের ভাষায় যাকে ‘আদারিং’ বলে।

আট.

অতএব বোঝা যায় ভালো লাগা আর ঘৃণা করা দুইটাই অনেক আদিম। গভীর মনসতত্ত্ব নির্ভর। মানুষ ভালোবাসতে ও ঘৃণা করতে পছন্দ করে। প্রেম করতে ও বিরহ দুইটাতেই আসক্ত কিনা জানি না তবে এটা তাকে ধাক্কা দেয়, টানে। গান শুনে বিরহ সামলে কাতরতা কমায় কিছু মানুষের জন্য। মানব সমাজের আদি ভাবনাগুলো আমাদের মাথায় এখনো সজীব। তোমরা/আমরা ও প্রেম-বিরহ মানুষের কাছে এখনো সবচেয়ে প্রধান। বিশ্ব রাজনীতিতে যে তীব্র বিদ্বেষ বর্তমান দুনিয়াতে তার সূত্র কেবল আদর্শ নয়, আরও গভীরে। মানুষ কেবল তার মেধা ও মননের সন্তান নয়, তার আদিম তাড়নার ইতিহাসেরও। আমরা আসলে সবাই একই ইতিহাসের ‘অপরাধী’।

সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //