রোকেয়া এখনো বর্তমান

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, মৃত্যু হয়েছে ৯ ডিসেম্বর। মৃত্যুর মাত্র ৫-৬ ঘণ্টা আগেও তিনি লিখেছিলেন, শেষ রচনা ছিল ‘নারীর অধিকার’, যা মাহে’নও পত্রিকায় মরণোত্তর প্রকাশিত হয়েছিল।

পৃথিবীতে খুব কম লেখক আছেন যার হাতের কলম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থামেনি। নয় ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস হিসেবে পালিত হয়। নারী এবং সামাজিক সংগঠনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করে। কারণ তাকে বাংলাদেশের লড়াই সংগ্রামে প্রাসঙ্গিক করে তোলা ছাড়া নারী আন্দোলনের অভিমুখ নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

রোকেয়া কোনো সর্বজনীন নারীবাদের প্রবক্তা ছিলেন না। তিনি যে জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত ছিলেন তারা একদিকে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বারা পিষ্ট, অপরদিকে মুসলমান সমাজ দীর্ঘকাল ইংরেজি না শেখার কারণে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, পেশা, জীবন-জীবিকা ও রাজনীতি অর্থাৎ সর্বত্রই হিন্দু জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়ে ছিল। তার মানে রোকেয়াকে লড়তে হয়েছিল তিনটি স্তরে।

প্রথমত ঔপবেশকিতার বিরুদ্ধে ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র ভারতের জনগণের একজন হয়ে। দ্বিতীয়ত হিন্দু শিক্ষিত সমাজ এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হাতে তৈরি সাহিত্যের আধিপত্যের বিরুদ্ধে। তিনি মুসলমান এবং নারী। ফলে সাহিত্যের জগতে তাকে স্থান পাওয়ার জন্য বিশেষভাবে লড়তে হয়েছে। সেটা সহজ ছিল না।

মুসলমান নারী এবং হিন্দু নারীর অবস্থা, সমস্যা ও সংকটের রূপও মুসলমান নারী থেকে ভিন্ন ছিল। তিনি তার জনগোষ্ঠীর মেয়েদের আধুনিক শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন, ‘নারীস্থান’ নিয়ে লিখেছেন, কিন্তু নারীকে তার স্বধর্মচ্যুত কিংবা সমাজের সামষ্টিক স্বার্থের বিপরীতে ব্যক্তিতান্ত্রিক হয়ে ওঠার কথা বলেননি।

নারীর মুক্তি তিনি চেয়েছিলেন বটে, সেখানে তার মধ্যে পাশ্চাত্য চিন্তার প্রভাব আছে, কারণ তিনি পাশ্চাত্যের নারীবাদী চিন্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, পড়েছেন। কিন্তু নারীর স্বাধীনতাকে উগ্র ব্যক্তিবাদের দিকে ঠেলে দেননি। তাকে ভালোভাবে চিনবার জন্য যথেষ্ট গবেষণা বাংলাদেশে হয়নি। 

তৃতীয়ত তিনি তার নিজের সমাজেই নারীর মুক্তি চেয়েছেন, সমাজের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে নয়। তাকে লড়তে হয়েছে তার নিজ জনগোষ্ঠীর পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন যদি নিজেদের ইতিহাসের ভেতর থেকে বেড়ে উঠতে চায় তাহলে বেগম রোকেয়ার সঙ্গে যোগসূত্র রচনার দরকার হবে। সেটা নামকা ওয়াস্তে বা তার জন্মদিনে স্রেফ তার নাম নিয়ে তাকে স্মরণ করলে হবে না। রোকেয়ার সময়, সমাজ ও বাস্তবতা কীভাবে তার চিন্তা ও কাজকে প্রভাবিত করেছে সেটা বোঝা জরুরি। 

রোকেয়ার নামের আগে ‘বেগম’ আমরা সবাই ব্যবহার করি বটে কিন্তু এই বেগম তার নামের অংশ নয়। তার আসল নাম রোকেয়া খাতুন। তার জন্ম হয়েছিল রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে। তার বাবা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের জমিদার, অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিলেন; মা রাহাতুন্নেসা।

রোকেয়ার দুই বোন এবং তিন ভাই ছিলেন, তার মধ্যে বড় বোন করিমুন্নেসা এবং ভাই ইব্রাহীম সাবের তার জীবনে অনেক গুরুত্বপুর্ণ প্রভাব ফেলেছেন। তার ভাই ইব্রাহীম সাবের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাস করেছিলেন, আর বড় বোন করিমুন্নেসা বাড়িতে ইউরোপিয়ান গভর্নেসের কাছে ইংরেজি শিখেছিলেন। রোকেয়া কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও বড় ভাই এবং বোনের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং বিশেষ করে ইংরেজি শিখতে পেরেছিলেন।

সেই সময়েও তিনি পশ্চিমা দেশের নারীবাদী লেখালেখি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন, Mary Wollstonecraft-এর লেখা A Vindication of the Rights of Woman (১৭৯২ সালে প্রকাশিত) বইটি পড়েছিলেন তার স্বামীর সহযোগিতায়। Mary Wollstonecraft-এর বই বর্তমানের নারীবাদীরা পড়েছেন কিনা জানি না, কিন্তু রোকেয়া তার চিন্তাকে অধুনিক নারীবাদের স্তরে নিয়ে গিয়েও তার নিজের সমাজ সংস্কৃতি, ধর্ম কোনো কিছু থেকেই বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হয়ে নারী অধিকারের পক্ষে লড়েছেন। এবং কঠিন ভাষায় আঘাত করেছেন।

তার শেষ রচনা, ‘নারীর অধিকার’ খুব ছোট, মাত্র তিন চার প্যারাগ্রাফের একটি প্রবন্ধ। অথচ এর মধ্যে অল্প কথায় তিনি তালাক এবং বয়স্ক পুরুষের বালিকা-বিবাহের প্রসঙ্গটি টেনেছেন, যা বর্তমান সময়েও খুব প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখছেন, “আমাদের ধর্মমতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় পাত্র-পাত্রীর সম্মতি দ্বারা।

তাই খোদা না করুন, বিচ্ছেদ যদি আসে তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় একতরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা?” বিবাহ বিচ্ছেদ এখনো এই ২০২২ সালেও একতরফা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে পার্থক্য হচ্ছে এখন স্ত্রী নিজেও তালাক দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশানে ২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৫২,৯০৪ ডিভোর্সের নোটিশ গেছে, তার মধ্যে ৩৪,৪৬৫টি নোটিশ স্ত্রীর পক্ষ থেকে ছিল।

কিন্তু এই চিত্র শুধু শহরের, রোকেয়া উত্তরবঙ্গের সেই সময়ের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তেমন চিত্র এখনো দেখা যাচ্ছে। সাধারণ এবং গরিব নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কোনো নোটিশ যায় না, স্বামী একতরফাভাবেই তালাক দিচ্ছেন। আরও ভয়াবহ হচ্ছে স্বামীর ইচ্ছায় সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া না নেওয়া চলছে। 

স্ত্রীকে তালাক দিয়ে কন্যা-সন্তানসহ বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে শহরের মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত পরিবারে বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টা আনুষ্ঠিকতা মেনে করা গেলেও স্বামী সন্তানের অভিভাবকত্ব নিতে চাইলে স্ত্রী অসহায় হয়ে পড়ছে। আইনের আশ্রয় নিয়েও খুব এগোতে পারছেন না।

এই বিষয়টি এখন খুব বড় একটি সমস্যা আকারে দাঁড়িয়েছে। গরিব নারীকে স্বামী সন্তানসহ ফেলে দিয়ে যাচ্ছে আর সম্পত্তির মালিক হওয়ার প্রশ্ন থাকলে সেখানে নারীকে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিতে দেওয়া হচ্ছে না। 

তার আর একটি প্রবন্ধ ‘ভ্রাতা-ভগ্নী’। এই লেখাটি পড়েও মনে হবে এখনকার কথা তিনি বলছেন। শুরু করেছেন এভাবে: “সাধারণত দুই মতের লোক দেখা যায়। একদল উন্নতি চাহে, পরিবর্তন চাহে, অপর দল বলে আমাদের যাহা আছে তাহাই থাকুক, পরিবর্তনের কাজ নাই।” প্রথমোক্ত দলকে আমরা উদার মতাবলম্বী এবং শেষোক্তকে রক্ষণশীল বা গোঁড়া বলিব। অধিক স্থলে আমাদের ভ্রাতৃগণ উদার মতাবলম্বী এবং ভগ্নীগণ রক্ষণশীল হইয়া থাকেন।

ক্রমে কালের বিচিত্র গতির পরিবর্তনে এখন কোনো কোনোস্থলে বিপরীত অবস্থাও দেখা যায়। অর্থাৎ ভ্রাতা সেই সেকেলে “গোঁড়া আর ভগ্নী নব বিভায় আলোকিতা।” বিষয়টি তিনি এক ভাই কাজেব ও দুই বোন সিদ্দিকা ও সুফিয়ার আলাপচারিতার মাধ্যমে খোলাসা করে বলেছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে ভাইবোনের এই আলাপচারিতা এবং বিতর্ক হচ্ছে মাকে দেখভালের প্রশ্নে। সমাজে দায়িত্ব পালন এবং চিন্তার গোঁড়ামি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর কী হতে পারে? 

ঘটনাটি হচ্ছে মায়ের ভরণপোষণের জন্য বোনেরা দায়িত্ব নিতে চেয়ে মামাতো ভাইয়ের কাছে চিঠি লিখেছেন। ভাই কাজেব বোনদের তিরস্কার করেন। এতে তার প্রথম রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামি ধরা পড়ে। বোনেরা দৃঢ়তার সাথে উত্তর দেন, “মামাতো ভাইকে পত্র লিখা যে বেহায়া বেগয়রতের (নিতান্ত লজ্জাহীনার) কাজ তাহা জানিতাম না। আমি তো সকল সহোদরের মতো জ্ঞান করি। যদি তোমাকে পত্র লিখা দোষণীয় না হয়, তবে তাঁহাকে পত্র লিখা দোষ হইবে কেন?”     

এই দীর্ঘ রচনায় তিনি কয়েকটি বাস্তব ঘটনার দিকে আলোকপাত করেছেন। যেমন মায়ের কাছে মেয়েরা টাকা পাঠাতে পারে না, কারণ যেখানে চিঠি মারা যায় সেখানে টাকা নিরাপদে মায়ের হাতে যেত না। মায়ের অলংকার ভাইয়েরা নিয়ে নেয়। এ প্রসঙ্গে রোকেয়া বলছেন, “ললনারা কেবল জড় স্বর্ণের বোঝা বহন করে; অলংকার ভাঙ্গিবার বা বিক্রয়ের ক্ষমতা তাঁহাদের নাই। ভাইদের ‘৫০ টাকা আবশ্যক হইলে আমাদের ৫০০ টাকার গহনা সুদের চাপায় মারা যায়।’ 

ভ্রাতা-ভগ্নীর এই আলাপ-তর্কে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারাকে তিনি যুক্তি দিয়ে স্বাধীন চিন্তা দিয়ে খণ্ডন করেছেন। পুরো প্রবন্ধটির প্রতি লাইনে রয়েছে নারীর অবস্থার প্রতিফলন এবং পুরুষের অন্যায়ের প্রতিবাদ। যদিও ভ্রাতা কাজেব শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করেননি। তিনি বললেন, “আর করিবও না। আমাদের গায়ে জোর বেশি।” এই বলে ভ্রাতা বেরিয়ে যান, বোন সুফিয়া উচ্চকণ্ঠে বললেন, “আমাদের রসনায় জোর বেশি।”      

রোকেয়া নারীর মুক্তি চেয়েছেন এবং সে লক্ষ্যে সমাজে যে যে কাজ করা দরকার তা করেছেন, কিন্তু কৌশলের দিক মনে রেখেছেন সব সময়। অর্থাৎ তিনি নিজেকে সমাজের বাইরে বা সমাজের ঊর্ধ্বে স্থাপন করেনি, ফলে নারীবাদী আত্মম্ভরিতার চেয়েও সমাজের সংস্কার কীভাবে করা যায় সেই দিকে নজর রেখেছেন।

একালের ফেমিনিস্টরা রোকেয়ার ‘কৌশল’-এর তাৎপর্য বুঝতে পারলে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কের টানাপড়েন মোকাবিলার গুরুত্ব ভালো বুঝতে পারবেন। নারীবাদ আর ব্যক্তিতান্ত্রিকতায় একাকার হয়ে যাবার বিপদ থেকে কীভাবে রক্ষা পেতে হয় রোকেয়া সেই শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন। 

আমরা রোকেয়া খাতুনকে নিয়ে গর্ব করি। তিনি যেভাবে চিন্তা, কাজ ও কৌশলের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, সেটা একালে খুবই শিক্ষণীয় হতে পারে। তাই তিনি শত বছর পার হয়ে গেলেও বর্তমান রয়ে গেছেন। এবং থাকবেন।

নারীনেত্রী ও কলাম লেখক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //