ইরানের হিজাব-বিতর্ক এবং কারণানুসন্ধান

ইরানে হিজাব-বিতর্ক নতুন নয়। ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবের আগে থেকেই শুরু হয়েছে শরিয়াহপন্থী কট্টর ইসলামবাদী এবং কট্টর পাশ্চাত্যপন্থী ও সেক্যুলারপন্থী বিশেষত রেজা শাহপন্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে কঠিন দ্বন্দ্ব। ইরানের জনগোষ্ঠী হিজাব-বিতর্কে তিন ভাগে বিভক্ত।

প্রথম দলটি অর্থাৎ যারা জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বিশেষত যারা ধর্মীয় শহর যেমন- কোম, মাশাদ ইত্যাদিতে বাস করেন বা সারা ইরানজুড়ে এসব শহরের ধর্মবেত্তা ও ধর্মীয় নেতাদের অনুগামী এবং সেই সাথে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বড় অংশটিই মনে করেন, যেহেতু ইরান একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র, তাই মেয়েদের হিজাব পরিধান অবশ্যই বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। এর কারণ পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে।

দ্বিতীয় দলটি পাশ্চাত্যপন্থী এবং এরা একইসাথে রেজা শাহপন্থী। এরা রেজা শাহ পাহলভীর আমলে শাহের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত একটি গোষ্ঠী বা তাদের উত্তর পুরুষ, যারা মনে করেন যেহেতু পাশ্চাত্য সভ্যতা বর্তমানে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাই ইরানের উচিত তার সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং ইরানের কট্টর ড্রেসকোডে পরিবর্তন আনা।

ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাসকারী ইরানিরা বেশিরভাগই রেজা শাহপন্থী, যারা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর দেশত্যাগ করেছেন এবং কয়েক দশক ধরে এসব দেশে বসবাস করছেন। এখানে তাদের সন্তান- সন্ততি আছে, তারাও তাদের বাবা- মায়ের মতো অনেকক্ষেত্রেই ইরানের ইসলামী সরকারের বিরোধী। আর যারা দেশে আছেন, তাদের বেশির ভাগই ইরানের শহরগুলোতে বসবাসকারী ধনী, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং এলিট জনগণ। 

রেজা শাহর আমলে ইরান যখন পশ্চিমা আধিপত্যের কবলে পড়েছিল, তখন দেশের জনগণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হলেও এই দলটি ছিল রেজা শাহ ও পশ্চিমের আশীর্বাদপুষ্ট। পঞ্চাশের দশকে যখন ইরানের জাতীয়তাবাদী নেতা মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ইরানের তেলসম্পদ জাতীয়করণ করতে চেয়েছিলেন ইংরেজদের হাত থেকে দেশের তেলসম্পদ লুণ্ঠন বন্ধ করতে, তখন রেজা শাহের সাথে এদের একটি অংশ পশ্চিমের সাথে হাত মিলিয়েছিল এবং মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উৎখাত করেছিলেন। তৃতীয় দলটি মজার। তারা ইসলামপন্থী; কিন্তু তারা মনে করেন যে, ইসলামের মধ্যে থেকেও মেয়েদের পোশাকে যুগোপযোগী পরিবর্তন আনা সম্ভব। 

এখানে আরেকটি কথাও বলে রাখা ভালো- পশ্চিমে বসবাসকারী ইরানিদের মধ্যে ইরানের কম্যুনিস্ট পার্টি হেজবে তুদে ই ইরানের (তুদে পার্টি) সদস্যরাও আছেন। যারা ইসলামী বিপ্লবের সময় ইসলামপন্থীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রেজা শাহকে উৎখাতে ময়দানে নেমেছিলেন। অবশ্য বিপ্লবপরবর্তীতে ইরানে এরা নানা দমন- পীড়নের শিকার হন এবং অনেকেই দেশ ত্যাগ করেন। এরা হিজাব প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত।

একটি অংশ মনে করে যে, ইরানে পাশ্চাত্য সভ্যতা অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে কম্যুনিজমের দ্বার উন্মুক্ত হবে। ফলে ইরানে হিজাব উৎখাত জরুরি। আর দ্বিতীয় অংশটি মনে করে, হিজাব বিষয়টি এখানে মুখ্য নয়। হিজাবের নামে পশ্চিমারা ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাতে চাচ্ছে।

সাম্প্রতিক ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান রাশিয়ার সমর্থক। রাশিয়া ইউক্রেনে ইরানি ড্রোন ব্যবহার করে যুদ্ধে বেশ সাফল্যও অর্জন করেছে। সেটি এখন পশ্চিমের অনেক দেশের গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। হিজাবতো ক্যাথলিক নানরাও পরেন। সেটি নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া কেন কথা বলে না? ইরানতো পশ্চিমের স্বল্পবসনা মেয়েদের মিনিস্কার্ট, হাপপ্যান্টস, বিকিনি, জি-স্ট্রিং, শ্লিংশট বিকিনি, নুড বিচ, ফ্রিবডি কালচার নিয়ে নাক গলাচ্ছে না। ফলে পশ্চিমের এই আক্রোশ যে অনেকটাই ইসলামোফোবিয়ার কারণে ও ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে, তা অনুধাবন করা মোটেও দুষ্কর নয়। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ইরান কীভাবে এই বিষয়টি ডিল করছে? ইসলাম মানুষকে বিধান দিয়েছে। সেই সাথে এই মহান দর্শন মানুষকে পরিবর্তনের সুযোগ এবং বিধান মান্যকারীদের ধৈর্য ও কৌশলের কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। জোরজবরদস্তি করে কোনো বিধান বেশিদিন মানানো যায় না। অন্যদিকে ইরানের ইসলামপন্থীরা বলছেন যে, ইরানেতো আমরা জোরজবরদস্তি করে হিজাব চাপাইনি। তা হলে পশ্চিমের অব্যাহত চাপে ইসলামী সরকার বহু আগেই ভেঙে পড়ত।

এ ছাড়া ইরানে হিজাবের পক্ষে অগণিত নারী মিছিল করেছে, তা পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো প্রচার করছে না। ১৯৩৬ সালে রেজা শাহের বিরুদ্ধে হেজাবের পক্ষে ইরানী নারীরা নেমেছিলেন আন্দোলনে। কারণ তারা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। সেটি কেউ উল্লেখ করছে না?

এবার আসা যাক মাহসা আমিনির বিষয়ে। ২২ বছর বয়সী এই কুর্দি বংশোদ্ভূত ইরানি তরুণী ১৩ সেপ্টেম্বর তার ভাইয়ের সাথে ইরানের কুর্দিস্তান থেকে রাজধানী তেহরানে যাচ্ছিলেন। তাকে পথিমধ্যে পুলিশ আটক করে এই কারণে যে, তিনি ঠিকমতো হিজাব পরেননি। তার চুল দেখা যাচ্ছিল এবং হিজাবের অবস্থা ইরানের ড্রেসকোডের সাথে পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।

১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। বর্তৃপক্ষ বলছে, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। অথচ পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আগে তিনি সম্পূর্ণই সুস্থ ছিলেন। ইরান কর্তৃপক্ষ এই মৃত্যুর দায় নিতে চাচ্ছে না। এর ফলে ইরানের কিছু শহরে কয়েকদিন ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। তার বেশি হয়েছে কিছু পশ্চিমা দেশে। ইরানে সরকারি হিসাব মতেই ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

সমস্যাটি আদতে হিজাব নিয়ে নয়। কর্তৃপক্ষ কেউ আইন অমান্য করলে তাকে কীভাবে শাস্তি দেবে এবং শাস্তি প্রয়োগের আগে বা পরে দায়ী ব্যক্তিকে তিনি কীভাবে হেফাজত করবেন, সেটি নিয়ে। ইরান শরিয়াহ মোতাবেক মাহসা আমিনিকে গ্রেফতার করতেই পারে। সেটি ইরান সরকারের দোষ নয়। এই আইন তারা বলবৎ ও প্রয়োগ করছে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ম্যান্ডেট নিয়েই। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা বাংলাদেশের সরকার গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ। কেউ পুলিশি হেফাজাতে মারা গেলে কি আমরা বলব- গণতন্ত্র হঠাও বা গণতন্ত্রের কোনো বিশেষ মূল্যবোধকে হঠাও। সেটা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা। যেমন- র‌্যাবের ক্রসফায়ার নিয়ে আমরা অনেকেই আমাদের ক্ষোভ এক সময় উদ্গীরণ করেছি। 

হিজাব একটি ইসলামী বিধান, যেটি শিয়া- সুন্নি, আহমদিয়া নির্বিশেষে সব মুসলমান কর্তৃক স্বীকৃত। সেটিতো একটি ইসলামী সরকার উৎখাত করতে পারে না। ইরানের সরকারকে দেখতে হবে দণ্ড প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা অপরাধীর ওপর কোনো অত্যাচার- নির্যাতন করছে কিনা, কুর্দি বা সুন্নি জনগণ পুলিশের আক্রোশের শিকার হচ্ছে কিনা। সরকার ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর খড়গহস্ত কিনা, সেটিও দেখার বিষয়। বিষয়টি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর যথাযথ কর্মতৎপরতার সাথেও সম্পর্কিত; কিন্তু ইরান সরকার বা পশ্চিমা মিডিয়া কেউই যৌক্তিক অবস্থান থেকে বিষয়টি ডিল করছে না।

গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //