বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের শঙ্কা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

দুর্ভিক্ষ কথাটা শুনলেই মনটা কেমন শঙ্কাগস্ত হয়ে ওঠে। ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’- প্রবাদটা মনে পড়ে। করোনা দুর্যোগ বিশেষত লকডাউনের দিনগুলোতে এমনটা মনে করা হয়েছিল যে, মহামারি ও দুর্ভিক্ষ দরজায় করাঘাত করছে। কিন্তু একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক-সামাজিক সক্ষমতা অর্জন করেছে, তাতে সেসময় মানুষের জীবন-জীবিকায় সমস্যা দেখা গেলেও, একটি মানুষও না খেয়ে মারা যায়নি।

তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের জিডিপি স্বাভাবিকভাবেই ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বিংশ্বব্যাংক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল।

কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ওই অনুমান কিছুটা হলেও পাল্টে দিচ্ছে। এখন বিশ্বব্যাংক বলছে, বর্তমান অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ হতে পারে। এটা ঠিক, সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ এখনো রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে একে কোনোভাবেই রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সীমিত যুদ্ধ বলা যাবে না। ন্যাটো এতে জড়িত। চীনও রয়েছে। সর্বোপরি বর্তমানে পরস্পর নির্ভরশীল এবং আণবিক বোমা সজ্জিত বিশ্বে যুদ্ধ কেবল অস্ত্রের ঝনঝনাতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। অর্থনৈতিক যুদ্ধটাই একটা পর্যায়ে প্রধান হয়ে ওঠে। 

বাস্তবে বিশ্ব এখন এই যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধ বিশ্বকে রাজনৈতিকভাবে তিন ভাগ করে দিচ্ছে। ইউক্রেন, রাশিয়া এবং নিরপেক্ষ বা ভারসাম্য রক্ষার পক্ষ। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার যেহেতু কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না, বরং বাড়ার আশঙ্কা, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধে গড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে; তখন নিরপেক্ষ পক্ষের অস্তিত্ব কতটুকু কীভাবে থাকবে, অর্থনৈতিক সংকট বাড়তে বাড়তে ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে, তা বলা অসম্ভব।  

এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  ৪ অক্টোবর শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির অঙ্গনে উপস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় বলেন, ‘আমি জাতিসংঘে গিয়েছি, সেখানে অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে ২০২৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।’ ‘প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে’ মন্তব্য করে তিনি  উৎপাদন বৃদ্ধি করে নিজেদের সঞ্চয় বাড়াতে’ এবং বিদ্যুৎ পানি সবকিছু ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে’ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

একটু খেয়াল করলেই এটা মনে করা যাবে যে, করোনা দুর্যোগের সময়ে বিভিন্ন ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করা হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহামারি ও দুর্ভিক্ষের কথা বলেননি। দুঃখ-কষ্টকে বিবেচনায় নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশবাসীকে অভয় দিয়েছেন। ত্রাণ ও টিকার মাধ্যমে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট থেকেছেন। কিন্তু এবারে তিনি সরাসরি দুর্ভিক্ষের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা এবং সঞ্চয়ী ও সাশ্রয়ী হওয়ার বিষয়ে তিনি যা বলেছেন, তাতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তি বিশেষত জনগণ কতটুকু সাড়া দেয়, ব্যবস্থা গ্রহণ করে, এটাই এখন দেখার বিষয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির কথা বলার পর ৮ অক্টোবর জানা গেল, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক বলছে, ধেয়ে আসছে মন্দা। আইএমএফ প্রধান বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক দুরবস্থার অন্ধকার নেমে আসতে পারে আগামী বছর। একাধিক ধাক্কা, তার মধ্যে আবার বুদ্ধিহীন যুদ্ধ অর্থনৈতিক চিত্রকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। অস্থায়ী হওয়ার বদলে মূদ্রস্ফীতি আরও স্থায়ী হয়েছে।’ বিশ্ব অর্থনীতির এই বিশাল ধাক্কা বাংলাদেশ এড়াতে পারবে কি না, কতটুকু পারবে, এটাই বর্তমান দিনগুলোতে দেশবাসীর সামনে প্রধান প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের বাতাস আমাদের গায়ে অনুভূত হচ্ছে। আমরা সামর্থ্য অর্জন করতে সক্ষম রয়েছি বিধায় এখনো বাতাস ধাক্কায় পর্যবসিত হয়নি। কিন্তু সার্কের কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে ধাক্কার আবর্তে। ২০২২ সালের মার্চে শ্রীলংকা ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। জিনিসপত্রের মূল্য হু হু করে বাড়তে থাকে। শুরু হয় খাদ্য ও জ্বালানি সংকট। এরই ধাক্কায় দেশটিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। সরকার পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয় না।

বিগত আগস্টে মূদ্রাস্ফীতি হয়েছে ৭০.২ শতাংশ, খাদ্যে যা ৮৪.৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছর আগে যে খাদ্য পাওয়া যেত ১০০ রুপিতে তা বর্তমানে হয় ১৮৪.৬০ রুপি। জুন-আগস্ট সময়কালে দেশটির অর্থনীতি ৮.৪ শতাংশে সংকুচিত হয়েছে। দেশটি ঋণখেলাপি হওয়ার পরই ভারত ৪০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এছাড়া ১২০ কোটি ডলারের আমদানি বিল স্থগিত করেছে এবং ৫ কোটি ডলার ছাড়ে ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। সেপ্টেম্বরে আইএমএফ ২৯০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর গত জুনে বলেছেন, ‘শ্রীলংকা যদি আর্থিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তড়িঘড়ি করে আইএমএফের কাছে যেত, তাহলে অর্থনৈতিক সংকট এড়ানো সম্ভব হতো।’ 

পাকিস্তানও অর্থনৈতিক সংকটের ঘূর্ণিচক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। তাতেও ধাক্কা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে বন্যা দেশটিকে আরও নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। দেশটিতে দারিদ্র্যের হার ২.৫ থেকে ৪ শতাংশ বা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বন্যার আগেই দেশটির ২০ শতাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। চাপে পড়ে ২৭ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী মিফতাহ পদত্যাগ করছেন। চারবারের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার ৫ বছর পর দেশে ফিরে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিচ্ছেন। ৫ অক্টোবর এডিবি বন্যায় আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা প্যাকেজ দিয়েছে। আগস্টের শেষ দিকে আইএমএফ ১১৭ কোটি ডলারের বেইল আউট প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

শ্রীলংকা দেউলিয়া আর পাকিস্তান চূড়ান্তভাবে দেউলিয়া হওয়ার পথে থাকলেও নেপাল সেদিকে যাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা এখনো রয়েছে। কারণ বিশ্বের যে কয়টি দেশের দেউলিয়াত্বের আশঙ্কা বেশি তার মধ্যে নেপালকে সামনে রেখেছিল অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি বলেছেন, তা হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ জুন পর্যন্ত ১১ মাসে বিগত বছরের একই সময়ের মধ্যে পর্যটন আয় বেড়েছে ৩ গুণ।

প্রবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্স দেড় শতাংশ বেশি। তবু বৈদেশিক ঋণ বাড়ছে। আমদানি বাড়ছে। রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। মূদ্রাস্ফীতি  ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। আইএফএম ২০২০ সালে ২১ কোটি ২০ লাখ এবং চলতি বছরের শুরুতে ৩৯ কোটি ৬০ হাজার ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, এখন আর ঋণ দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

উপরে উল্লিখিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে দেওলিয়া হওয়া, বেইল আউট পাওয়া কিংবা অর্থনীতির ক্ষেত্রে ধাক্কা সামলাতে শেষ পর্যন্ত দেশগুলোকে আইএফএম বা দাতা সংস্থার কাছেই ধরনা দিতে হচ্ছে। বিশেষভাবে স্বনির্ভরতা বিবেচনায় বিষয়টা সুখকর তো নয়ই বরং দুশ্চিন্তারও কারণ। ধাক্কা আসার আগেই বিগত জুলাই মাসে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে।

প্রচার রয়েছে ঋণ চাহিদার পরিমাণণ ৪৫০ কোটি ডলার। অপরদিকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। তিনি আরও বলেছেন, আইএফএম কী শর্তে ঋণ দিতে চাচ্ছে, তা দেখতে হবে। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কথা বিবেচনায় নিয়ে বলতেই হয়, বাংলাদেশ ওই দেশের মতো ভুল করতে চায়নি। আগেই ঋণ চেয়ে রেখেছে।

২০২৩ সাল আসতে আর মাত্র আড়াই মাস বাকি। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সব ব্যবস্থা নিয়ে রাখুক, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। বিশ্বব্যাপী যে ভয়াবহ পরিস্থিতি ধেয়ে আসছে বলে অনুমান করা হচ্ছে, তার অনেকটাই আমাদের হাতে নেই। কিন্তু কিছু বিষয় রয়েছে সরকার ও জনগণের হাতে। বিগত নির্বাচনের আগে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায়’ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব ‘কৌশল ও পদক্ষেপ’ গ্রহণের অঙ্গীকার হয়েছিল এগুলো সব বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বোপরি ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা অবশ্যই সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। সরকারের ভালো পদক্ষেপের পক্ষে যে দেশবাসী দৃঢ়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করে, তা  ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে।

২০২৩ সাল জাতির জন্য একটি বিশেষ বছর। কেননা এ বছরের শেষে বা পরের বছরের প্রথম দিকে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায় এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, নির্বাচনকে ঘিরে দেশকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলানোর চেষ্টা হতে পারে। এটা তো স্বতঃসিদ্ধ যে, অর্থনীতির সংকটের পিছু পিছু আসে রাজনৈতিক সংকট এবং দুই সংকট মিলে পরিস্থিতিকে টালমাটাল করে দিতে পারে। তাতে দেশের জনগণের জীবন ও জীবিকা হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহভাবে বিপন্ন। এদিকটি চিন্তা করে সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক, এটাই বর্তমান দিনগুলোর একান্ত কামনা।

কলাম লেখক 

রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //