বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট

আমার এক বন্ধু জানতে চেয়েছে, ভারতে যেতে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা লাগে কেন, ভুটান এবং নেপালের অধিবাসীর তো লাগে না।

শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর বহু দেশে যেতে আমাদের সবুজ পাসপোর্টে ভিসা থাকতে হয়। আমাদের পাসপোর্টে বিনা ভিসায় ৪১টি দেশে ভ্রমণ করা যায়। সিঙ্গাপুর এবং জাপানের পাসপোর্ট দিয়ে বিনা ভিসায় যাওয়া যায় ১৯২টি দেশে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘হ্যানলি অ্যান্ড পার্টনার্স’ প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের পাসপোর্টের র‍্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে, ১৯৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১০৩।

আমাদের অনেকের সবুজ পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমণের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। এর কারণ সততার মাপকাঠিতে আমাদের দেশের লোকজনের অবস্থান উঁচুতে নয়। উগ্রপন্থি ধর্মান্ধদের হাতে হলি আর্টিজানে যেদিন বিদেশিরা অকাতরে প্রাণ হারাল সেদিন থেকে বিদেশে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও কমল। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর কাছেও আমাদের পাসপোর্টের গুরুত্ব ভারতের চেয়ে কম। বহির্বিশ্বে ভারতের লোকদের সুনাম রয়েছে, কারণ তারা বিদেশে গিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হয় না। 

বাংলাদেশে কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এখনো পুলিশ সদর থেকে সারাদেশে পুলিশের সব ইউনিটে চিঠি দিয়ে জঙ্গি হামলার ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। জনগণের ধারণা ছিল, ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের তৎপরতা থেকে দেশ এখন মুক্ত। কিন্তু অতি সম্প্রতি চিকিৎসক শাকির বিন ওয়ালীকে গুম করা হয়েছে মর্মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হয়। পরে গোয়েন্দা পুলিশ স্বীকার করেছে, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, ছাত্রাবস্থায়ও একই অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং এখনো তিনি জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রক্ষা করে চলছেন। আনসার আল ইসলামের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে শাকিরের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত করেছে।

গত ২৩ আগস্ট থেকে কুমিল্লা থেকে সাত শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়। অভিযোগ ওঠে গুম হওয়ার। কুমিল্লা ইস্পাহানি স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আবরারুল হককে ঢাকার মগবাজার থেকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানতে পারে ওই সাত শিক্ষার্থীর সঙ্গে আবরারুল হকেরও জিহাদে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার পরীক্ষা শুরু হওয়ায় সে যেতে পারেনি। কীভাবে এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় তাও সে পুলিশকে জানিয়েছে।

আবরারুল হক আরও জানিয়েছে যে, একাধিক বৈঠকে অংশ নেওয়ার পর জঙ্গি সংগঠনে তার নাম লেখা হয়েছে। আবরারুল হককে গ্রেপ্তারের পর চিকিৎসক শাকিরের জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ যুবকদের জিহাদ সম্পর্কে দীক্ষা দিয়েছেন শাকির। শাকিরের বাবা এ কে এম ওয়ালিউল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। 

অনেকের ধারণা, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, আমলা, পুলিশ, সাংবাদিক জঙ্গি হতে পারে না, এরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। আল কায়েদার প্রধান মতাদর্শিক নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি কিছুদিন পূর্বে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। তিনি ছিলেন চোখের ডাক্তার। ২০১১ সালে আল কায়েদার তৎকালীন শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হলে আয়মান আল-জাওয়াহিরি আল কায়েদার নেতৃত্ব নেন।

২০০১ সনে আমেরিকার টুইন-টাওয়ারে হামলার মূল বাস্তবায়নকারী ছিলেন আল জাওয়াহিরি। আমেরিকা থেকে তার মাথার মূল্য ঘোষণা করা হয়েছিল আড়াই কোটি ডলার। কায়রোর আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম রাবিয়া আল-জাওয়াহিরির নাতি আয়মান আল-জাওয়াহিরি এক সময়ে কায়রো শহরেই একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে পরবর্তীকালে চরমপন্থি ইসলামিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার জন্য প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে হত্যার অভিযোগে জাওয়াহিরিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমাদের দেশে এবং বহির্বিশ্বে এমন অনেক চিকিৎসক আছেন যারা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অন্যদিকে ওসামা বিন লাদেনও ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, তিনি জেদ্দার বাদশাহ আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেন। 

আগেই উল্লেখ করেছি, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানের নৃশংস ঘটনা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে তলানিতে নামিয়ে দিয়েছে। পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকজন বিদেশিকে খুন করা হয়েছে, যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই ঘটনার আগে-পরে কয়েকজন ব্লগারকে কতল করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ প্রতিটি দেশকে নিয়মিত মনিটর করে থাকে। যান এবং চলাফেরার নিরাপত্তা নেই বলেই পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুময় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটক আসে না, অথচ চেরাপুঞ্জির শুধু বৃষ্টি দেখার জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভারতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কড়াকড়ি করছে তা কিন্তু নয়। অনেক মুসলিম দেশের পাসপোর্টেও বিনা ভিসায় এর চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক দেশ ভ্রমণ করা যায়। 

মালদ্বীপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই প্রভৃতি দেশ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও এই সকল দেশের পাসপোর্ট ভিসার অপরিহার্যতা বিচারে অনেক উন্মুক্ত। দুবাইতে সারা বছর পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে, অনেক সময় পর্যটকদের ঢলও নামে। মালদ্বীপে শরিয়া আইন রয়েছে, সেখানে মুসলমান ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী ভোটার হতে পারে না।

১৯৮৯ সালে মরিয়ম নামের যে মেয়েটিকে মালয়েশিয়ায় আমি স্কার্ট পরা দেখেছি, ঠিক সেই মেয়েটিকে বিশ বছর পর মালদ্বীপে দেখলাম হিজাব পরা। মেয়েটি আর কেউ নন, তিনি মালদ্বীপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নর। মালয়েশিয়ায় তিনি আমাদের সঙ্গে স্কার্ট পরে ব্যাডমিন্টন খেলেছেন, কিন্তু মালদ্বীপে আমার সঙ্গে ফটো তুলতেও রাজি হননি। ধর্মীয় বিধান কঠোরভাবে মানলেও মালদ্বীপের মুসলমানেরা উগ্র নয়, কোনো কড়াকড়ি নেই, বিয়ার হাতে সুইমিং কস্টিউম পরে সমুদ্র সৈকতে বালির মধ্যে শুয়ে মেয়েরা রোদ পোহাচ্ছে; মালদ্বীপের লোকেরা তাদের পাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করছে, কাজ করছে, কোনো অস্বস্তি নেই। মালদ্বীপের পাসপোর্টে ৮৮টি দেশ বিনা ভিসায় ভ্রমণ করা যায়। জর্ডান, মালয়েশিয়ার অবস্থাও অনুরূপ। শুধু নিজ দেশের অভ্যন্তরে নয়, বিদেশে গিয়েও এই সকল দেশের লোকজন জেহাদি কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় না। 

লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, সবচেয়ে ভালো মুসলমানও সাধারণত শরিয়া অধ্যুষিত দেশে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যায় না, যেতে চায় নাস্তিক অধ্যুষিত দেশগুলোতে। কারণ দেশগুলো নিরাপদ, বিদেশি বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণা বা আক্রোশ  দৃশ্যমান নয়। তবে ইদানীং ইউরোপসহ আমেরিকা ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশেও উগ্রবাদের আবির্ভাব হচ্ছে, মুসলমানদের রাস্তাঘাটে হেনস্তা করা হচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই সকল দেশের উগ্রবাদীরা শুধু মুসলমানদের প্রতিপক্ষ করছে, অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের নয়। এর কারণও রয়েছে।

চুয়াত্তর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের অযৌক্তিক নির্যাতন অনেক মুসলমানকে উগ্রবাদে দীক্ষা নিতে প্ররোচিত করেছে। এছাড়াও আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অযাচিত হস্তক্ষেপে অনেক মুসলমান ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এর চেয়েও  ইউরোপের যে কাজটি মুসলমানদের বেশি বিক্ষুব্ধ করেছে তা হলো আমাদের নবীজীর আঁকা কার্টুন পত্রিকায় প্রকাশ করা। বাক স্বাধীনতার নামে তাদের এই অপকর্ম অনেক মুসলমানকে আক্রোশী করে তুলেছে। কেউ কেউ এত বেশি আক্রোশী হয়ে উঠেছেন যে, সুযোগ পেলেই প্রতিবাদ আর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। কিন্তু উগ্রপন্থিদের প্রতিশোধ গ্রহণের ঘটনা বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমাদের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশি পাসপোর্টে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ভ্রমণ করা গেলেও অন্য দেশের ভিসা পেতে কষ্ট হয়। 

পৃথিবীর যে সব দেশের পাসপোর্টে ভ্রমণ করতে ভিসা লাগে না, আমাদের লাগে কেন? প্রথম কথা হচ্ছে, নিজের ও পরিবারের অন্ন সংস্থানের জন্য অবৈধ পন্থায় আমাদের অন্য দেশে অনধিকার অনুপ্রবেশ করতে হচ্ছে। আমরা বেড়াতে গিয়ে আর ফেরত আসি না, ওমরাহ হজে গিয়ে কাজের অনুসন্ধান করি। আমরা যারা ভিন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করি, তাদের নাগরিকত্ব গ্রহণের পূর্বে শপথ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতি মেনে চলার ওয়াদা করতে হয়; কিন্তু নাগরিকত্ব পাওয়ার পর শপথের কথা আর মনে থাকে না। তাই তো ফ্রান্স এবং লন্ডনের উগ্রপন্থি মুসলমান নাগরিকেরা প্যারিস এবং লন্ডনে স্বাচ্ছন্দ্যে হামলা করতে পারে। উগ্রপন্থিদের হিংসাত্মক আচরণে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মধ্যে তৈরি হয়েছে ইসলাম ফোবিয়া বা ইসলাম ভীতি।

তাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিদেশ ভ্রমণ নির্বিঘ্ন ও সহজ করতে বাংলাদেশ সরকার সবুজ পাসপোর্টের পাশাপাশি আরও দুই ধরনের পাসপোর্ট ইস্যু করে থাকে। লাল পাসপোর্টে সচরাচর ভিসা লাগে না, সরকারি পাসপোর্টেও ভিসা ছাড়া অনেক দেশ ভ্রমণ করা যায়। একই দেশে তিন ধরনের পাসপোর্ট- এটাও আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //