চালের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে তো!

যুদ্ধ মানুষকে বিপর্যস্ত করে। নিয়ে যায় বাস্তবতার চরম পর্যায়ে। বিশ্বায়নের যুগে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের আঁচ সইতে হচ্ছে বহু দেশকে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব আমাদের উপরও পড়েছে। দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য রাতারাতি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে চালসহ প্রতিটি পণ্যের উপর। চালের দাম বেড়েই চলেছে। তবে শুধু অনিয়ম, দুর্নীতি বা যুদ্ধের কুপ্রভাব বাদ দিলেও প্রকৃতিও এবার বিরূপ প্রভাব ফেলেছে আমাদের কৃষিতে। 

চলতি বছর বোরো মৌসুমে হাওরাঞ্চলে তিন দফা বন্যার কারণে বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে। উপকূল ও উত্তরাঞ্চলে হঠাৎ অতিবৃষ্টির কারণেও মাঠে পাকা ফসল নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, বোরোতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ লাখ টন ফলন কম হয়েছে। আউশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে ২০ লাখ ৫০ হাজার টন।

অন্যদিকে খরা ও একই সাথে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচের উপর প্রভাব ফেলছে। যার ফলে বোরো ধানে কৃষকের উৎপাদন খরচই উঠছে না। এবার খরার কারণে ধানে বাড়তি খরচ হয়েছে ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এক বিঘা (৩৩ শতাংশের হিসেবে) জমিতে সেচের খরচই ১৪০০-১৫০০ টাকা থেকে বেড়ে এবার ২০০০-২৫০০ টাকা ছাড়িয়েছে। প্রচণ্ড খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে সেচ খরচ বৃদ্ধি, কৃষি শ্রমিকের বাড়তি মজুরিসহ বিভিন্ন কারণে বোরো ধানের উৎপাদন খরচ এবার বেশি। 

অন্যদিকে অতি খরায় ধানের উৎপাদনও কমেছে ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু ধান পরিচর্যা এবং কাটায় কৃষি শ্রমিকের মজুরি ছিল বেশি। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার প্রায় ৪০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে আমনের ফলন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আগামী নভেম্বর থেকে আমন ধান কাটা শুরু হবে।

রংপুরের কৃষকরা বলছেন, ইউরিয়া সার ও ডিজেলের বাড়তি দামে চলতি মৌসুমে আমন লাগানো থেকে ফসল ঘরে ওঠা পর্যন্ত প্রতি একরে গত বছরের চেয়ে ১১ হাজার টাকা ব্যয় বাড়বে। এবার প্রতি একরে কমপক্ষে ব্যয় হবে ৩৬ হাজার টাকা। গত আমন মৌসুমে ব্যয় হয়েছিল ২৫ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টরে আমন চাষ করতে গড়ে ইউরিয়া লাগে ১৮০ কেজি। প্রতি কেজি ইউরিয়ায় ৬ টাকা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। গত বছর আমন ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার ৬৩৬ হেক্টর। প্রতি হেক্টরে উৎপাদনে ২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। চলতি মৌসুমে রংপুরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৩৬ হেক্টর। এবার প্রতি হেক্টরে ১১ হাজার টাকা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সে অনুপাতে ব্যয় হবে ৩৬ হাজার টাকা। তাই এবার শুধু রংপুরেই আমন উৎপাদনে কৃষকদের অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১৭ কোটি ৯৯ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮০ টাকা।

সব মিলিয়ে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত চালের বিক্রয় মূল্যও বাড়াতে হবে। নতুবা কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধান উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ইতোমধ্যে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের ধান উৎপাদনে অনীহা দেখা দিয়েছে, উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, লাভজনক কৃষির দিকে ঝোঁক ইত্যাদি কারণে অদূর ভষ্যিতে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে বৈকি! 

দেশে চাল নিয়ে এমন জটিল পরিস্থিতি গত এক যুগে আর তৈরি হয়নি বলে বিশেষজ্ঞদের মত। বোরো, আউশ ও আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বোরো ধান সংগ্রহে সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল, সেটি পূরণ হয়নি। দুই দফা শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতকে চাল আমদানির সুযোগ করে দিয়েও সুফল পাওয়া যায়নি। অনুমোদন দেওয়ার দুই মাস পর আমদানিকারকেরা ১০ শতাংশ চালও আনতে পারেননি বলা হচ্ছে। 

এ পরিস্থিতিতে সরকার নিজেই তিনটি দেশ থেকে চাল কেনার চুক্তি করতে যাচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে সরকার চাল কিনছে বলে পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। এমনকি প্রায় একই মানের চাল প্রতি টন ভারত থেকে যে দরে কেনা হচ্ছে, ভিয়েতনাম থেকে তার চেয়ে ৭৮ ডলার বেশি দরে কেনা হচ্ছে। সাধারণভাবে দুই দেশের মধ্যে চালের দামের পার্থক্য ২০ থেকে ৪০ ডলার হয়ে থাকে। এবার চাল আমদানিতে সেই পার্থক্য ছাড়িয়ে যাচ্ছে। 

এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, দেশের এমন সংকটময় মুহূর্তে সরকারের যেখানে কম দামে খাদ্য আমদানিতে জোর দেওয়া দরকার সেখানে বেশি দামে চাল আমদানি করছে। তার উপর আছে বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। 

বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক সমাজ মনে করে, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট মজুতের মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। এতে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। অতি মুনাফালোভী এই সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি চালের বাজার। ফলে খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়েও বেড়েছে ভোগান্তি। এমতাবস্থায় চালের দাম আবার সাধারণের নাগালের বাইরে না চলে যায়।

বিশ্ববাজারে যেখানে চাল, গমের দাম কমেছে, সেখানে বেশি মূল্য চাল, গম কেনা কতটা যৌক্তিক হবে? এমনিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের দাম বেড়েছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। মূল্যবৃদ্ধির এ তালিকায় উপরের সারিতে আছে চাল। হু হু করে বাড়ছে চালের দাম। কিন্তু ক্রেতার আয় বাড়েনি। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রতিটি মানুষকে খাদ্যের দামের সাথে সমঝোতা করতে হচ্ছে প্রয়োজনীয় খাদ্যের তালিকা কাটছাঁট করে। সেখানে যদি প্রধান খাদ্যের দাম বেড়ে যায় তাহলে ব্যাপক খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতিতে পড়তে হবে সাধারণ মানুষকে।


লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //