দুর্গাপুজো ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ বাংলাদেশ জন্মলগ্নের মর্মবাণীর যথার্থ প্রতিফলন ঘটে এই কথাগুলোর ভেতর দিয়ে। হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য দুর্গাপুজো আরাধনা-উপাসনার আর এই পুজোকে ঘিরে শারদীয় উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির। একইভাবে ঈদও মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ইবাদত-বন্দেগির আর ঈদকে ঘিরে উৎসব সকলের।

এমন ভাবনা বাঙালির মন জয় করতে পেরেছিল বলেই এই মানচিত্রের জনগণ পাকিস্তানি আমলে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে অংশ নিয়েছে, দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আপামর জনগণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিজয় ছিনিয়ে স্বাধীন দেশে জাতীয় চার নীতি সংবলিত সংবিধান গ্রহণ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হবে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা।’ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই বিগত বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালন করেছি। এতদ্সত্ত্বেও মনে প্রশ্ন জাগছে, আসন্ন দুর্গাপুজোয় কি হিন্দু সম্প্রদায় আরাধনা-উপাসনা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারবে? বাধাহীন নির্মল উৎসব-আনন্দ কি সবাই মিলে উপভোগ করতে পারা যাবে?

উৎসবের আনন্দের মধ্যে কেমন যেন এক ভয় ও শঙ্কা কাজ করছে! প্রশ্ন উঠছে গতবার কুমিল্লার ঘটনা নিয়ে যা হয়েছে, এবার কি তেমনটা ঘটতে পারে! ঘরপোড়া গরুর মতো ভয় ও শঙ্কা থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দুর্গাপুজোকে সামনে রেখে বিগত ১ আগস্ট পিরোজপুর সদর উপজেলায় মন্দিরের বিগ্রহ ভাঙচুর, ৬ আগস্ট খুলনার মোংলায় মন্দিরের বিগ্রহ ভাঙচুর, ৯ আগস্ট কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় মন্দিরে বিগ্রহ ভাঙচুর, ২১ আগস্ট বগুড়ার শিবগঞ্জে মন্দিরের বিগ্রহ ভাঙচুর, ২৬ আগস্ট সাতক্ষীরা সদরের দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর, ২৭ আগস্ট হরিরামপুর উপজেলায় সর্বজনীন দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর, ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার নবাবগঞ্জের কোন্ডা গ্রামে মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর প্রভৃতি ঘটনা ঘটেছে।

এ সবই হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য মর্মান্তিক ও স্পর্শকাতর বিষয়। এসব অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয় ঘটনার বিচার ও দোষীদের শাস্তি হওয়ার বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় ছেদ টানা এবং পুজো-উৎসবের সময় ভয়-শঙ্কা নিরসন করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সরকারের। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, এবারে প্রতিটি মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা বাধ্যতামূলক। এছাড়া পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক ও ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে। সরকারের এই ঘোষণা মানুষের মনে ভরসা জোগাচ্ছে। এবার বাংলাদেশে পুজো হচ্ছে ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে। গতবারের চেয়ে এক হাজার বেশি। এতসব পুজোর মধ্যে বাড়ির পুজো বাদে সর্বজনীন পুজোগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু সংখ্যক মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা যে রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

গতবার দুর্গাপুজোর সময়ের অনভিপ্রেত এবং উল্লেখিত ভাঙচুরের ঘটনা সত্ত্বেও পুজোর সংখ্যা বিবেচনায় নিলে সুস্পষ্ট হয়ে যায়, অগণিত মানুষ ভয়-শঙ্কা তুচ্ছ করে উৎসব-আনন্দে শামিল হতে চাইছে। সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে যদি জনগণের এই সাহসকে একীভূত এবং যৌথভাবে দাঁড়ানো যায়, তবে যেসব অসুররূপী ব্যক্তি-গোষ্ঠী-মহল, যারা প্রতিমা ভাঙতে চায়, আরাধনা-উপাসনা করতে দিতে চায় না, উৎসবকে কলঙ্কের কালিমায় ডোবাতে চায়, তারা পিছু হটতে বাধ্য।

পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের আন্দোলন তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা বাধিয়েছিল। দাঙ্গার চারদিনের মাথায় ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে এলাকায় এলাকায় জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরদিন দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাঁচাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের জীবন বিপন্ন হয়। অধ্যাপক ফাদার নোভাক ও বুদ্ধিজীবী আমীর হোসেন চৌধুরী দাঙ্গাকারীদের আক্রমণে নিহত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ইত্তেফাক অফিসে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নেতাসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের সভায় ৯৯ সদস্যবিশিষ্ট দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। 

ওই কমিটি দাঙ্গাবিরোধী একটি প্রচারপত্র বের করে, যার শিরোনামে লেখা ছিল ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও।’ বাস্তবেই রুখে দাঁড়িয়েছিল পূর্ব বাংলা। পাড়া-মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরোধ বাহিনী গঠিত হয়েছিল। এতেই দাঙ্গাকারীরা পিছু হটে। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী জাগরণ রুখতেই ১৯৬৫ সালে আইয়ুব সরকার বাধায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ। গুজব রটানো হয়, নিষ্প্রদীপ মহড়ার সময় জগন্নাথ হল, ওয়ারী, শাঁখারীবাজার থেকে টর্চ লাইট দিয়ে ভারতীয় যুদ্ধ বিমানকে সংকেত দেওয়া হচ্ছে। তখন গড়ে ওঠে সম্মিলিত প্রতিরোধ। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্লোগান তোলেন, ‘পূর্ব বাংলা অরক্ষিত কেন?’ 

বাস্তবে ওই দুই স্লোগান ছিল, ‘জয় বাংলা’, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা যমুনা’, ‘পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন?’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগানের উত্তরসূরি। এসব স্লোগানই হয় বাংলাদেশের জন্মলগ্নের সম্মিলিত মূলমন্ত্র, যা জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে’, আমরা স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হতে দিতে পারি না! ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গণমানুষকে রুখে দাঁড়াতেই হবে। সরকারকে অবশ্যই এই কাজে নিয়ামক ভূমিকা রাখতে হবে। ইতিহাস অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে। 

সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে যে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য বিষয়ে লেখা রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ সংবিধান সুরক্ষা করার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি জনগণেরও। তাই সরকার ও জনগণকে একসাথে অন্ধকারের অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সংবিধানিক দায়িত্ব।

বিগত নির্বাচনের আগে বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে যে, ২০১১ সালে সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী পাস করে ‘সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতি গোষ্ঠী ও উপজাতীয়দের অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান এবং তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আবারও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।’ বাস্তবে কথা ও কাজের সমন্বয় সাধনের স্বার্থে ‘সুপ্রতিষ্ঠিত’ হয়েছে কি না- আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এই প্রশ্নে সরকারি দলের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সরকারেরও এই প্রশ্নটি গভীরভাবে বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক।

নির্বাচনী ইশতেহারে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এই মর্মবাণীর প্রতিফলন ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ‘নির্মূল’ করে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে পাঁচটি লক্ষ্য ও পরিকল্পনা তুলে ধরে। বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা মধ্যেও ‘ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের’ জন্য ইশতেহারের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সরকার কিছুই করেনি বা করছে না, এমন বলাটা হবে ভুল। তবে এক. ‘অর্পিত সম্পত্তি সংশোধনী আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে’ অঙ্গীকারটি আমলাতান্ত্রিক ও আইনি জটিলতার জন্য ঈপ্সিত গতিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দুই. ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে।’ এ দুটো অঙ্গীকার পাথরচাপাই পড়ে গেছে।

 মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন বন্ধ, নিপীড়নকারীদের বিচার ও শাস্তি প্রদান সুনিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে এই দুই অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হলে দুর্গা পুজোর আনন্দ-উৎসব বহু গুণে বৃদ্ধি পেত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের জনগণের একান্ত কামনা হবে, ২০২৩ সালের দুর্গাপুজোর আগে সরকার সব অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবে এবং বঙ্গবন্ধুসহ শত লক্ষ শহীদের স্বপ্ন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।


শেখর দত্ত
কলাম লেখক 
রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //