কী খাচ্ছি

আমাদের অফিস-আদালত, কল-কারখানায় প্রায়শই দেখা যায় সেফটি ফার্স্ট কথাটা। কিন্তু জৈববৃত্তির অন্যতম অনুষঙ্গ খাবারদাবারের ক্ষেত্রে কি সেটা মানা হয়? বিশেষ করে বাংলাদেশে? সাম্প্রতিককালে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে; বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতা।

কিন্তু কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে আমরা কী খাচ্ছি, কীভাবে খাচ্ছি, খাদ্যের নিরাপত্তার কথা কি ঠান্ডা মাথায় একটিবারও ভাবছি? ক্ষেত থেকে শুরু করে পেটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কী কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারে, চলুন একবার দেখে নেওয়া যাক। 

কৃষকের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত যে শাক-সবজি আমরা খাই সেটা ক্ষেত থেকে তোলার আগে, বিশেষ করে রাতে ওই ক্ষেতে কী ঘটে থাকে? সেখানে অবাধে চলাফেরা করতে পারে শেয়াল, কুকুর, ইঁদুর, বাদুড়, পোকামাকড় ইত্যাদি। তাদের মলমূত্র বা বিষ্ঠা শাক-সবজিতে লাগতে পারে। এসব প্রাণীর কোনোটা আবার অসুস্থ অথবা জীবাণুবাহীও হতে পারে। ভালোভাবে ধুয়ে বা জীবাণুমুক্ত করে কি শাক-সবজি বাজারজাত করা হয়? ধোয়া হলেও কোথায়, কীভাবে ধোয়া হয়? 

যে পাত্রে বা ঝুড়িতে ক্ষেত থেকে শাক-সবজি তোলা হয় সেগুলো হয়তো ঘরের বাইরে খোলা কোনো জায়গায় ফেলে রাখা ছিল। কুকুর-বেড়াল বা গরু-ছাগল নোংরা করে থাকতে পারে। ব্যবহারের আগে কি সেগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করে নেওয়া হয়? অতঃপর ঝুড়ি থেকে যে বস্তায় ভরে বাজারে পাঠানো হয়, সেগুলো কি সিমেন্টের নাকি কীটনাশকের বস্তা? ব্যবহারের আগে বস্তাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় তো? 

এবার আসি পরিবহনের কথায়। যে ট্রাক বা পিক-আপ ভ্যানে করে শাক-সবজিগুলো শহরে পাঠানো হয় সে বাহনে কি আগের ট্রিপে গরু-মহিষ, মুরগি, মাছ, কীটনাশক, সার বা কেমিক্যাল পরিবহন করা হয়নি? এসব মালামাল বোঝাই করার আগে গাড়িগুলো কি যথাযথভাবে পরিষ্কার করা হয়? 

শাক-সবজিগুলো পরিবহনে চেপে মাঝরাতে রাজধানীর কাওরানবাজারে এসে বস্তাগুলো ধপাস ধপাস করে যে জায়গায় ফেলা হয় তার চেহারা কি দিনের ক্রেতারা কল্পনা করতে পারবেন? বস্তার মুখ গলে শাক-সবজিগুলো বেরিয়ে এসে যে ডালায় বিক্রির জন্য প্রদর্শিত হয় সেটা কোন পানি দিয়ে ধোয়া কিংবা আদৌ ধোয়া হয়েছে কিনা তা কে জানে? অথবা যে দাঁড়িপাল্লায় মেপে বিক্রি করা হয় সেটা কি পরিষ্কার ও নিরাপদ? 

অন্যের কথা ছাড়ূন। নিজে যে ব্যাগে করে আজ বাজার করছেন পূর্বে তাতে কী কী মালামাল আনা নেওয়া করেছেন? ঠিক মতো ধুয়েছেন তো? এমনকি বাজার থেকে আনা শাক-সবজিগুলোর কিছুটা হয়তো রান্না করা হয়েছে, বাকিটা কি সরাসরি ফ্রিজে ঢোকানো হয়নি? রান্নার আগে সেটা ভালোমতো ভিজিয়ে, ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়েছিল তো? ফ্রিজে ওঠানো অংশটুকু ময়লা, জীবাণুসহ উঠে পড়েনি তো? খাওয়াদাওয়া শেষে অতিরিক্ত খাবারটুকুই বা কী করেছেন? কাঁচা শাক-সবজি, মাছ, মাংসের সঙ্গে রান্না করা ওই খাবার একই ফ্রিজে রাখছেন না তো? ফ্রিজের বদ্ধ পরিবেশে কোটি কোটি ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার লুটোপুটির দৃশ্য খালি চোখে দেখা যায় না বটে, তাই বলে কি তারা নেই? 

এত যে রোগবালাই, অসুখ বিসুখ তার কারণ হয়তো আমরা অনেকেই খুঁজে পাই না। কিন্তু নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যায় না, মুড়ি-মুড়কির মতো মুঠো মুঠো ওষুধ খায় না- এমন পরিবার এদেশে আছে নাকি? এত যে বুক জ্বলা, পেটের পীড়া কিংবা হার্ট, লাং, কিডনি, ফুসফুস, ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিসের মতো অসুখ বিসুখ তা কি এমনি এমনি? এর পেছনে উন্নত পুষ্টিগুণসম্পন্ন কিন্তু অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন ও রোগজীবাণুযুক্ত খাবারদাবারের ভূমিকা কতটুকু- তা কি ভেবে দেখার সময় আজও আসেনি? 

নিত্যদিনের খাদ্য হিসেবে এখানে শাক-সবজির অবতারণা একটা উদাহরণ মাত্র। দুধ, ডিম, মাছ, মাংসের ক্ষেত্রেও কি অনুরূপ অপরিচ্ছন্নতা ও অসাবধানতা ঘটছে না? দুধের কথাই ধরুন। এটি একটি সম্পূর্ণ ও আদর্শ খাবার। আমরা যতগুলো পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাই, তার মধ্যে দুধের উপকারিতা সবচেয়ে বেশি। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় আমিষ, ভিটামিন ও খনিজের চাহিদা পূরণে এর বিকল্প নেই। মাঝারি এক কাপ দুধে প্রায় ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরি শক্তি, ৮-১০ মিলিগ্রাম মানসম্মত ফ্যাট, ৮-১০ মিলিগ্রাম উন্নত প্রোটিন, ১৩-১৫ মিলিগ্রাম শর্করা, ২৪-২৫ মিলিগ্রাম ঝুঁকিবিহীন কলেস্টেরল, ৯৮-১০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস এবং অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে। আবার দামেও সস্তা এবং পাওয়া যায় সহজে। দুধের মধ্যে যে ল্যাকটোজ ও ক্যাজিন থাকে তা অত্যন্ত শক্তিশালী ও মহামূল্যবান এবং পৃথিবীর আর কোন খাবারে এগুলো পাওয়া যায় না। সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং একটি সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে এই দুধ ও দুধজাতীয় খাবারের সমতুল্য আর কী হতে পারে! 

আমার প্রশ্নটা অন্যখানে। দুধ দোহনের আগে কি হাত ও পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়? কিংবা গাভীর ওলান? পরিমাপ ও বহনের জন্য যেসব পাত্র ব্যবহার করা হয় তার মান ও পরিচ্ছন্নতা কেমন? বাজারে নেওয়ার পথে যদি কলাপাতা, খেজুরপাতা বা কচুরিপানা ব্যবহার করা হয় তবে কি তা নিরাপদ? কিনে এনে কিছুটা হয়তো জ্বাল দিয়ে খাওয়া হয়, বাকিটা কেউ কেউ ফ্রিজে তুলে রাখেন বিনা জ্বালে। দিনের পর দিন সংরক্ষণের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করছেন না তো? 

দুধের মহামূল্যবান গুণাগুণ সম্পর্কে অনেক মানুষই হয়তো ঠিকমতো জানে না। কিন্তু এর অনাকাঙ্ক্ষিত এক সমঝদার হলো ব্যকটেরিয়া। দুধের গন্ধ পেলে তাদের মাথা ঠিক থাকে না। সবকিছু ফেলে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং মারাত্মক অ্যাসিডিক বিক্রিয়া ঘটায়। দুধ তাই দ্রুত পচনশীল দ্রব্যে পরিণত হয়। তবে আপনি একটু সচেতন হলে অতি উপকারী এ খাবারটিকে ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়ার হাত থেকে সহজেই রক্ষা করতে পারবেন। বজায় থাকবে এর খাদ্যগুণ ও মান। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে প্রতিদিন প্রত্যেকের প্রায় এক পোয়া বা ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা উচিত। 

এবার ডিমের কথায় আসি। ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু সেদ্ধ করার সময় কেউ কি লক্ষ করেছেন যে, তাপ পেলে সবকিছু যেখানে নরম হয়ে আসে সেখানে ডিম ক্রমশ শক্ত হয়ে ওঠে। কিংবা ডিমের শক্ত আবরণেও যে অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে তা কি জানেন? এগুলোকে পোরাস বা বহুরন্ধ্র বলে। ডিম ঠিকমতো না ধুলে এই পোরাসের মাধ্যমে জীবাণু খোসার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। আবার সাবান সোডা দিয়ে ধুলেও কিন্তু তা অন্যরকম ক্ষতির কারণ হতে পারে। তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হয় যদি ভালোভাবে পরিষ্কার না করে রান্না করা হয় কিংবা ফ্রিজে রাখা হয়। অথচ বায়োলজিক্যাল ভেল্যু বিবেচনায় সেদ্ধ ডিমের প্রায় ৯৪ ভাগ পুষ্টি আমাদের শরীরে কাজে লাগে যা দুনিয়ার আর কোনো খাবার থেকে কল্পনাও করা যায় না। তবে কাঁচা, অধাসেদ্ধ বা তেলে ভেজে খেলে ডিমের গুণাগুণ কিন্তু বহুলাংশে কমে যায়। পৃথিবীর প্রায় সকল পুষ্টিবিদ প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। 

মাংস নিয়ে দুটি কথা না লিখলে অনেকের প্রিয় এ খাবারটির প্রতি অবিচার করা হবে। মাংসে আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন, অ্যাসিড ও খনিজ লবণ বিদ্যমান। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং খামারিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গরু, খাসি, মুরগি, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদির মাংসে আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। কিন্তু জবাই করা থেকে খাওয়ার আগ পর্যন্ত মূল্যবান এ খাবারটিকে ঘিরে কী পরিমাণ দূষণের ঝুঁকি থাকতে পারে সে বিষয়ে সচেতন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সাধারণ কটি প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই।

জবাইয়ের আগে প্রাণীটি অসুস্থ ছিল কিনা তা কি পরীক্ষা করা হয়েছিল? যে অস্ত্র দিয়ে জবাই করা হলো সেটাতে আগের দিনের মাংসের কুচি, রক্ত, জীবাণু লেগে ছিল না তো? যেখানে জবাই করা হলো, যার উপর রাখা হলো, যেখানে কাটাকুটি করা হলো সে জায়গাগুলো পরিষ্কার, নিরাপদ তো? দোকানে যে পানি দিয়ে মাংস ধোয়া হলো তা দূষিত ছিল না তো? আর আপনার বাজারের ব্যাগ, বাসায় এনে ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত পানি, সকালের মাংস সন্ধ্যায় কিনে আনা, কাঁচা মাংসের অংশবিশেষ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ফ্রিজে তুলে রাখা, রান্না করা মাংসের অতিরিক্ত বা বেঁচে যাওয়া অংশ একই ফ্রিজে চালান করা- এ সবের কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি বা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তা ভেবে দেখেছেন তো? 

কয়েকটা অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারের সহজে পরিহারযোগ্য ঝুঁকির কথা ছোট করে তুলে ধরলাম। ছোট ছোট ভুলে অনেক ভালোও যে মন্দে রূপান্তর হতে পারে সে বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করাই এ লেখার উদ্দেশ্য। অবশ্য উপসংহারে যাওয়ার আগে পানির নাম না নিলে ভালো খাবারের প্রাথমিক তালিকা অপূর্ণ থেকে যাবে। আমরা সবাই জানি, পানির অপর নাম জীবন। ব্যবহারের দোষে বা সচেতনতার অভাবে বেঁচে থাকার অন্যতম এ অনুষঙ্গও কিন্তু মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিশেষ করে ট্যাপের পানি ভুলেও সরাসরি পান করার সুযোগ নেই। অবশ্যই ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে খেতে হবে। প্লাস্টিকের ক্যান বা বোতলে রাখা পানি স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়।

আবার দেখা যায়, ট্যাপের অপরিষ্কার পানি দিয়ে গ্লাস ধুয়ে সেই গ্লাসে ফোটানো পানি ঢেলে মহাসুখে খাওয়া হচ্ছে। কিংবা খাবারের আগে প্লেট বা হাত ধোয়ার জন্য আপনি ট্যাপের বা দূষিত পানি ব্যবহার করছেন না তো? শেষ কথা হলো ফুড সেফটি বা খাদ্য নিরাপত্তায় অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। প্রয়োজনীয় আমিষ, প্রোটিন ও শর্করার পর্যাপ্ততা বা সহজলভ্যতা অনেকাংশে নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু সেফ ফুড বা নিরাপদ খাবার গ্রহণের ব্যাপারে আপনাকেই সচেতন হতে হবে, সক্রিয় হতে হবে। আর হ্যাঁ, যাই খান- দেখেশুনে খাবেন, মাপ বুঝে খাবেন।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প